কলকাতা ডার্বি: মোহনবাগান – ইস্ট বেঙ্গল দ্বৈরথের স্মরণীয় কিছু ম্যাচ [পর্ব- ২]
মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল দ্বৈরথের স্মরণীয় ম্যাচগুলোর কথা বলতে গেলে সামনে চলে আসে অজস্র ঘটনা। অধুনা ইউরোপের বিভিন্ন নামী দ্বৈরথের চেয়েও পুরনো কলকাতা ডার্বির ইতিহাস। বয়োবৃদ্ধ নাগরিক সমাজ এখনো স্মৃতিকাতর হন ডার্বি ম্যাচ নিয়ে। আজও প্রিয় ফুটবল ক্লাবের জয় কিংবা পরাজয়ের সাথে মিশে থাকা নানা স্মৃতিতে ডুব দেন তারা সময়ে সময়ে। হিসেবের খাতা খুললে বেরিয়ে আসে যাপিত জীবনের নানা অধ্যায় যার পরতে পরতে ডার্বির আবেগ, অনুভূতি ও উচ্ছাসের ছাপ রয়ে গেছে আজও অমলিন। গত পর্বের মতো আমাদের এবারের লেখাতেও থাকছে স্মরণীয় তিনটি ডার্বি ম্যাচের গল্প।
![kolkata-derby-mohun-bagan-vs-east-bengal-1st-part](https://banglavibe.com/wp-content/uploads/2020/09/PicsArt_09-30-10.30.20.jpg)
১৯৮০ সালের ১৬ই আগস্ট ইডেনে অনুষ্ঠিত ডার্বি ম্যাচ একটি মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। ৭০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ চলছিল। স্টেডিয়ামের ডি ব্লক সেদিন অতিরিক্ত লোকে ঠাসা। ভিড় সামলাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে রেফারি মোহনবাগানের দুই খেলোয়াড় দীলিপ ও বিদেশ বসুকে লাল কার্ড দেখালে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতে। শুরু হয় ধস্তাধস্তি আর তাতে প্রাণ হারায় ১৬ জন মানুষ। ১৯৮০ সালের১৬ আগস্টকে বলা হয় ভারতীয় ফুটবলের কালো দিন।
![Kolkata Derby](https://banglavibe.com/wp-content/uploads/2020/09/PicsArt_09-30-10.31.14-749x395.jpg)
সেই হতভাগা ফুটবলপ্রেমীদের উদ্দেশ্য করে কিংবদন্তী শিল্পী মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘খেলা ফুটবল খেলা/খোকা খেলতে গেল/সেই সকালবেলা../ আর ফিরল না৷’
ফুটবলপ্রেমী জনতার প্রার্থনা এমন দিন যেন আর না আসে দুনিয়ার কোনো প্রান্তে।
১৯৯৭ সালের ১৩ জুলাই এর ম্যাচটি ছিল ইতিহাস গড়া। ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল মুখোমুখি দুই দল। সেদিনের লড়াই শুধু খেলোয়াড়দের মধ্যেই নয়, দুই কোচ মোহনবাগানের অমল দত্ত এবং ইস্ট বেঙ্গলের পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতাও ছিল। সে সময় অমল দত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন নতুন ডায়মন্ড সিস্টেম নিয়ে। ম্যাচের আগেই শুরু করেছিলেন মাইন্ড গেম। ইস্ট বেঙ্গলের খেলোয়াড় বাইচুং ভুটিয়াকে ডেকেছিলেন ‘চুং চুং’ বলে। বিপরীতে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় একান্ত মনোযোগী হয়েছিলেন তার খেলোয়াড়দের প্রতি। তিনি ছিলেন চৌকস একজন টিম ম্যানেজার। তিনি খেলোয়াড়দের চিত্তে জমে থাকা বারুদে স্রেফ টোকা দিয়েছেন, জ্বলে অঙ্গার হয়ে গেছে মোহনবাগান। সেই বাইচুং ভুটিয়ার দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে ইস্ট বেঙ্গল জয়লাভ করেছিল ৪—১ গোলে। বিজয়ের হাসি হেসেছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। ম্যাচের পূর্ববর্তী উত্তেজনায় আগ্রহী হয়ে সে ম্যাচের সাক্ষী হতে সেদিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে জমা হয়েছিল ১ লাখ ৩১ হাজার দর্শক, যা আজও পর্যন্ত একটি রেকর্ড হয়ে আছে।
তৃতীয় ম্যাচটি একটি সংঘর্ষের ঘটনা। ২০১২ সালের আই লিগ এর ম্যাচ। ঘটনার সূত্রপাত মাঠে খাবরা ও নির্মল ছেত্রীর মধ্যে বল দখলের লড়াইকে কেন্দ্র করে। এদিন প্রথম থেকেই ঘটছিল একের পর এক ঘটনা। অল্প সময়ের ব্যবধানে রেফারি হলুদ কার্ড দেখান মোহনবাগানের তিনজন খেলোয়াড়কে। রেফারির দিকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে লাল কার্ড দেখতে হয় বাগানের খেলোয়াড় ওডাফা ওকোলিকে। এসব দেখে আর শান্ত থাকতে পারেনি সমর্থকরা। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতে। সেদিন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যেন পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছিল ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্টের সেই কালো দিনটির। পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। হুড়োহুড়ির মাঝে গ্যালারি থেকে ঢিল ছুঁড়ে মারা হয় মাঠে। মাথা ফেটে যায় বাগানের খেলোয়াড় রহিম নবির। যদিও তিনি প্রতিপক্ষ ইস্ট বেঙ্গলের খেলোয়াড়দের কাঁধে চেপেই মাঠ ছেড়েছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানায় মোহনবাগান। এজন্য তাদের দুই বছরের নির্বাসন দেওয়া হয়। পরে অবশ্য সে সাসপেনশন উঠে গিয়েছিল। ম্যাচটিতে ইস্ট বেঙ্গলকে ৩—১ গোলে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ঘটনায় অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছিল মোহনবাগানের সমর্থকদের প্রতি।
আধুনিক কলকাতায় সময়ের সাথে সাথে ঘটি-বাঙ্গালের দূরত্ব হয়তো ঘুচে গেছে অনেকটাই। কিন্তু ডার্বি ম্যাচকে কেন্দ্র করে ঠিকই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় পুরো শহর। পাড়ার মোড়ে, টং দোকানে, হাট-বাজারে তক্ক চলে সমানে সমান। ডার্বি ম্যাচকে কেন্দ্র করে তলানিতে থাকা শীর্ণকায় রুগ্ন ফুটবল যেন নতুন জীবনের পানি পায় কলকাতায়। ফুটবলের সমৃদ্ধি ও জনপ্রিয়তার নতুন আহ্বান জানিয়ে দিয়ে যায় কলকাতা ডার্বি। ছেলে, বুড়ো সবার মাঝে নতুন করে ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ তৈরী করতে কলকাতা ডার্বির অবদান অনস্বীকার্য। ঐতিহ্যের ফুটবল আর বাংলার এ প্রাণের দ্বৈরথ বেঁচে থাকুক শতাব্দীর পর শতাব্দী।