ক্যারোলি তাকাস – হার না মানা এক যোদ্ধার গল্প

সময়টা ১৯৩৮ সাল, হাঙ্গেরিয়ান আর্মিতে কাজ করলেও মনেপ্রাণে ‘ক্যারোলি তাকাস’ ছিলেন পুরোদস্তর পিস্তল শুট্যার। স্বপ্ন ছিল তার হাতকে বিশ্বের সেরা নিশানাবাজের হাত বানানো। অর্থাৎ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগিতা অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতা। কঠোর অনুশীলন করে ইতোমধ্যেই হাঙ্গেরির ছোট বড় প্রায় সমস্ত জাতীয় পুরস্কারই তার নখদর্পনে। দেশের হয়ে অলিম্পিকে অংশ নিতে কোমর বেধে নেমেছিলেন তিনি। শুধু তারই নয়, প্রতিটা হাঙ্গেরিয়ানের বিশ্বাস ছিল তাদের ক্যারোলির হাতেই উঠবে গোল্ড মেডেল।

বিশ্বজয়ের স্বপ্নে যখন বিভোর তখনই সেই ছন্দে ছন্দপতন হয় ক্যারোলির। ১৯৩৮ এর শুরুর দিকে আর্মিদের ট্রেনিং চলাকালীন সেখানে তাকেও যোগ দিতে হয়। এখানেই ঘটে গেলো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। বছরের পর বছর অনুশীলন করে যেই হাতকে তিনি বিশ্বজয়ের অস্ত্র বানিয়ে ছিলেন সেই হাতে একদিন হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়! নির্জীব হয়ে যাওয়ায় ডাক্তাররা তার এতোদিন ধরে শান দেওয়া হাতকে কেটে ফেলেন। নিমিষেই থমকে যায় ক্যারোলির স্বপ্ন।

যারা বিশ্বাস করতো ক্যারোলি তাদের হয়ে বিশ্বজয় করবে তারাই ধরে নিলো ক্যারোলি অধ্যায় এখানেই শেষ। কিন্তু তিনি যে ক্যারোলি, এভাবে নিজের লালিত স্বপ্নকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারেন না তিনি। সবাই যেখানে তার শেষ দেখে ফেলেছিল সেখান থেকেই তিনি তার ক্যারোলি হয়ে উঠার গল্পটা শুরু করছিলেন। হাসপাতালে শুয়ে ভাবতে লাগলেন, হোক না বাম হাত! তাতে কি? মানুষটা আমি সেই ক্যারোলিই। ডান’হাতে পারলে বা’হাতে কেনো পারবো না?

যেই ভাবা সেই কাজ! সুস্থ হয়ে ফিরে সবার অগোচরে অনুশীলন শুরু করলেন তিনি। যে বা’হাত দিয়ে তিনি কোনো কাজ করতে পারতেন না এমনকি কলমও পর্যন্ত ধরতে পারতেন না সেই হাতকেই তিনি বিশ্বের সেরা হাত বানানোর প্রতিজ্ঞা করলেন। ১৯৩৯ এ হাঙ্গেরিতে অলিম্পিকের জন্য শ্যুটারদের প্রতিযোগিতায় শুরু হয়। সেখানে তিনিও অংশ নিতে আসেন। যেখানে তাকে দেখে অন্যন্য প্রতিযোগিরা বলাবলি করতে লাগলো,

“এই হলো স্পোর্টসম্যানশীপ, খেলায় হার-জিত নয় অংশগ্রহণই মুখ্য। তুমি তাই প্রমাণ করে দিলে।”

কিন্তু আসল সত্যিটা তাদের কেউই জানতো না। বাঘা বাঘা সব শুট্যারদের পিছনে ফেলে এক হাতের ক্যারোলিই জিতে গেলেন এবং জানিয়ে দিলেন তিনি সেখানে শুধু অংশ নিতেই আসেননি, জিতার জন্যই এসেছেন। সবাই জেনে গেলো সেই পুরোনো ক্যারোলি ফিরে এসেছেন তাদের হয়ে স্বপ্নজয় করতে।

কিন্তু ভাগ্যবিধাতা বোধহয় অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারনে ১৯৪০ এর অলিম্পিক হলো না। একটু সময়ের জন্য থমকে গেলেও থেমে গেলেন না ক্যারোলি। পরের অলিম্পিকের জন্য নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তাকে এবারও দূরে ঠেলে দিল। বিশ্বযুদ্ধের কারনে ১৯৪৪ সালের অলিম্পিকও হলো না।

অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সময় ক্যারোলি।

 

এমন অবস্থায় পৃথিবীর যেকোন মানুষেরই যেখানে হতাশায় দুমড়ে মুচড়ে যেত সেখানে ক্যারোলি তখনও অবিচল। লক্ষ্য ঠিক করলেন ১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে লড়বেন তিনি। অলিম্পিক শুরু হলো, সারাবিশ্ব অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো পৃথিবীর তাবৎ হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়ে অলিম্পিক জিতলেন ক্যারোলি – দ্যা ম্যান উইথ দ্যা অনলি হ্যান্ড!

ক্যারোলির পারফর্ম্যান্সে সারাবিশ্ব মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো, কিন্তু থামলেন না ক্যারোলি! ঠিক করলেন ১৯৫৪’র অলিম্পিকেও লড়বেন তিনি। সারাবিশ্বকে জানিয়ে দিবেন তার জয় কোনো চমক ছিলোনা। তাই বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে মনের জোরও যেন বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। পরেরবার অলিম্পিক আসলো, অংশ নিলেন ক্যারোলি। জিতলো কে? সারা দুনিয়াকে অবাক বিস্ময়ে বিস্মিত করে এবার এমন একজন জিতলেন যিনি অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পিস্তল শুট্যার হিসেবে টানা দুই অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতার কৃতিত্ব দেখালেন। কে তিনি? তিনি আর কেউ নন, তিনি ক্যারোলি তাকাস – দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন আর্ম!

Similar Posts

2 Comments

    1. ধন্যবাদ আপনাকে প্রিয় পাঠক। ক্যারোলির জীবন থেকে আমরা আসলেই অনেক কিছু শিখতে পারি।

      আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

Comments are closed.