সূর্য অক্সিজেন ছাড়া জ্বলে কিভাবে?
সূর্য আমাদের এই চেনা পৃথিবীর প্রায় সকল শক্তির উৎস। এর আলো ছাড়া আমাদের পৃথিবী কল্পনা করা সম্ভব না। এই গভীর কালো মহা অন্ধকারের মহাকাশে আমরা একটুকরো আলো খুঁজে পাই সূর্যের কাছ থেকে। জীবনের আশার আলো দিয়ে যায় অনবরত। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি কিভাবে এই আলো উৎপন্ন হয় গভীর কালো অন্ধকারে? আমরা সবাই জানি যে দহনে অক্সিজেনেরর প্রয়োজন। কিন্তু মহাকাশ তো বলতে গেলে শুন্য। সূর্য অক্সিজেন ছাড়া জ্বলে কিভাবে ?
এই প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে আমাদের সুপরিচিত মাধ্যাকর্ষণ বলে। মাধ্যাকর্ষণ বলের জোরেই সূর্য তার কেন্দ্রে ফিউসন ঘটিয়ে আলো উৎপন্ন করে। যার থেকে আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় শক্তি পাই। গাছপালা তাদের খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের অক্সিজেন দিয়ে থাকে। সূর্য যে মাধ্যাকর্ষণ বলের জোরে আটকে রাখে পৃথিবীকে সেই বলের জোরেই শক্তি উৎপন্ন করে আমাদের আলো দেয় ।
সূর্য কি দিয়ে তৈরি?
সূর্যের মাঝে সলিড কোন বস্তু নেই। এটি উত্তাপে উজ্জ্বল হওয়া একটি গ্যাসের গোলক। সূর্যের বেশির ভাগই হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। ফিউসন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন কে ক্রমাগত হিলিয়ামে পরিনত করছে সূর্য। এই বিক্রিয়ার প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। আলো তৈরি কিন্তু সূর্যের মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং হিলিয়াম হলো এই বিক্রিয়ার মূল উৎপাদন। আলো উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয়। সূর্য একটি হলদে বামন নক্ষত্র । সূর্যের থেকেও ঢের গুনে বড় নক্ষত্র রয়েছে মহাশুন্যে ।
সূর্য অন্য সব নক্ষত্রের মতো পুরোটাই গ্যাস দিয়ে তৈরি । এটি ৯১ % হাইড্রোজেন এবং ৮.৯ % হিলিয়াম দিয়ে তৈরি । ভরের বিচারে ৭০.৬ % হাইড্রোজেন এবং ২৭.৪ % হিলিয়াম দিয়ে তৈরি । মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সূর্যের সমস্ত গ্যাসকে তার কেন্দ্রের দিকে টানতে থাকে । বিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করেছেন যে সূর্য এখন তার মধ্যম বয়সে অবস্থান করছে। আরও ৬.৫ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত এটি জ্বলতে থাকবে । তারপর এর জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে । সূর্যের শেষ পরিনতি হবে শ্বেত বামন হিসেবে ।
সূর্য এর কাঠামোঃ
সূর্য ছয়টি অঞ্চলে বিভক্ত । এই ছয়টি অঞ্চলের তাপমাত্রা ভিন্ন ভিন্ন । ছয়টি অঞ্চল হলোঃ
১। কোর
২। রেডিও অ্যাক্টিভ জোন
৩। কনভেক্টিভ জোন বা পরিচলন এলাকা
৪। দৃশ্যমান অঞ্চল যাকে ফটোস্ফিয়ার বলে
৫। ক্রমোস্ফিয়ার
৬। সবচেয়ে বাইরের অঞ্চল করোনা
সূর্যের সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান হলো এর কোর । প্রায় ১৫ মিলিয়ন ( ১৫০ লক্ষ ) ডিগ্রি সেলসিয়াস । যা আসলে ফিউসন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য যথেষ্ট এবং উপযুক্ত পরিবেশ । এই অতি উত্তপ্ত তাপমাত্রায় দুটি হাইড্রোজেন পরমানু মিলে একটি হিলিয়াম পরমানু তে পরিণত হয় । একে প্রোটন প্রোটন চেইন রিএ্যাকশন বলা হয় ।
শক্তি কোরে উৎপন্ন হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে । এবং কোর থেকে যতো উপরে উঠা যায় তাপমাত্রা আস্তে আস্তে ততোই কমতে থাকে । সূর্যের সার্ফেসের তাপমাত্রা ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস । এই তাপমাত্রা কার্বন এর তৈরি ডাইমন্ড , গ্রাফাইট শুধু গলাতেই সক্ষম নয়, একে বাষ্পীভূত করতেও সক্ষম ।
সূর্যের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াঃ
সূর্যের আসল শক্তি আসে এর ভর থেকে । আইনেস্টাইন এর বিখ্যাত সুত্র E = mc2 এর সুত্র অনুযায়ী ভর শক্তিতে পরিণত হয় । কিন্তু এই প্রক্রিয়া মাত্র ০.৭ % কার্যকারী । অর্থাৎ বিক্রিয়ার দ্বারা পুরো ভরই শক্তিতে পরিণত হয় না বরং এর মাত্র ০.৭ % শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু সূর্যের ভর অনেক বেশী বলে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়।
সূর্যের এই বিক্রিয়া সংগঠনের জন্য প্রয়োজন তার গ্রাভিটি । মাধ্যাকর্ষণ বলই ফিউসন বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য এর কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় তাপ উৎপন্ন করে দেয় । সূর্যের ভর তার মাধ্যাকর্ষণ বলের জোরে প্রচুর চাপ উৎপন্ন করে।ফলে গ্যাস গুলো কাছাকাছি আসতে থাকে। যতই কাছাকাছি আসে ততোই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে । সূর্যের বিশাল ভর এর কেন্দ্রে প্রচুর চাপ ও তাপ উৎপন্ন করে। ফলে ফিউসন ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা এবং পরিবেশ উৎপন্ন হয় ।
আমারা সবই জানি বৃহস্পতি একটি গ্যাস জায়েন্ট। সূর্য যেমন গ্যাস দিয়ে তৈরি , কোন সলিড সারফেস নেই বৃহস্পতিও সেইরকম। বিজ্ঞানিরা হিসেব করেছেন যে যদি বৃহস্পতির ভর আরও বেশ কয়েক ডজন বৃহস্পতির ভর যোগ করে বাড়ানো যেত তাহলে এটি নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠতো। অর্থাৎ বৃহস্পতির কেন্দ্রে ভরের কারনে ফিউসন বিক্রিয়ার শুরু হয়ে যেতে পারতো । ফলে তারার মতো এটি জ্বলতে পারতো। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে যে নক্ষত্র একটি নিদিষ্ট ভর অতিক্রম করলেই তৈরি হতে পারে ।
প্রোটন প্রোটন চেইন রিঅ্যাকশানঃ
আমারা সবাই জানি হাইড্রোজেন একটি মাত্র প্রোটন দিয়ে গঠিত। সূর্যের কেন্দ্রে ২ টি প্রোটন বা হাইড্রোজেন মিলে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। এই দুটি প্রোটন চারটি ধাপে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এই হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে চারটি প্রোটন ও নিউট্রন এর ভর তাদের আলাদা আলাদা ভরের থেকে সামান্য একটু কম । এই সামান্য একটু ভর ই সরাসরি ফোটনে অর্থাৎ আলোতে রূপান্তরিত হয় । ফলে আলো তৈরিতে কোন অক্সিজেনেরই প্রয়োজন হয় না। ভর সরাসরি শক্তিতে পরিণত হয়। আর এটিই হচ্ছে সূর্যের অক্সিজেন ছাড়া আলো তৈরির মূল রহস্য।
আজ তাহলে এ পর্যন্তই। আগামীতে দেখা হবে নতুন কোন বিষয় নিয়ে।