কালো চাল: এক অসাধারণ গুণসম্পন্ন খাদ্যশস্য

আমরা জানি, ভাত ছাড়া বাঙালীর একদম চলে না। বহুকাল আগে থেকেই বাঙালীর খাদ্য তালিকার প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে ভাত। এখন এই ভাতই যদি হয় আরো পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ, হয়ে ওঠে বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধী মহৌষধ তা হলে আর মন্দ কি! কালো চাল বা ব্ল্যাক রাইস এমনই একটি চাল, যা আজ বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসচেতন প্রতিটি মানুষের রান্না ঘরে জায়গা করে নিয়েছে।

Black rice-A food grain of extraordinary quality

ইতিহাস

কালো চাল বা ব্ল্যাক রাইসের নাম আমাদের অনেকের কাছে বেশ অপরিচিত হলেও এর ইতিহাস আসলে প্রাচীন। হাজার বছর ধরে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই চালের চাষ হয়ে আসছে। চীন দেশের ইতিহাসে এই চাল নিয়ে অদ্ভুত এক নিয়ম শোনা যায়। আগে চীনে শুধু রাজ পরিবারের সদস্যরাই এই চাল খেতে পারতেন। সাধারণ মানুষের জন্য এই কালো চাল ছিল নিষিদ্ধ। অনেকের ধারনা, পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে এই চালকে রাজকীয় খাবার হিসেবে সংরক্ষন করাই ছিল এই নিয়মের মূল উদ্দেশ্য। আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চল গুলোতেও কয়েকধরনের কালো ও বাদামী ধানের চাষ হয়ে আসছে। কৃষকরা এতকাল এর গুরুত্ব অনুধাবন করে এটির চাষ করে আসছেন। এধরণের উচ্চ আঁশ যুক্ত চালের ভাত সাধারণত বাংলার কৃষকেরা খেতেন। এই ভাত খেলে অনেকক্ষণ পেট ভরা থাকে। ফলে শুধু সকালে আর বিকালে খেলেই তাদের চলে যেত।

পুষ্টি উপাদান

প্রতি ১০০ গ্রাম কালো চালে রয়েছে শক্তি ৩৫৬ কিলো ক্যালরি, প্রোটিন ৮.৮৯ গ্রাম, স্নেহ উপাদান ৩.৩৩ গ্রাম, শর্করা ৭৫.৫৬ গ্রাম, আঁশ ২.২ গ্রাম, লৌহ ২.৪ মিলি গ্রাম (উইকিপিডিয়া অনুযায়ী)।

এই চালের কালো হওয়ার মূল কারন অ্যান্থোসায়ানিন নামক এক প্রকার উপাদান। এটি মূলত অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অন্যান্য চালের তুলনায় এর আমিষের পরিমান বেশি। এতে চিনির পরিমান কম এবং আঁশের পরিমান বেশি। এছাড়া রয়েছে ভিটামিন ই, যার রয়েছে বিশেষ রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা।

উপকারিতা

কালো চাল উপকারিতার দিক থেকে সাদা চাল থেকে অনেকটাই এগিয়ে। এর থেকে প্রাপ্ত উপকারিতা সমূহ হলো-

  • এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উন্নত করে।
  • সাদা চালের তুলনায় এতে অধিক পরিমান আঁশ রয়েছে, যা পরিপাকতন্ত্রের জন্যে ভালো।
  • চিনির পরিমান কম, যার কারনে ডায়বেটিসে আক্রান্ত রোগীর জন্য উপযুক্ত।
  • এই চাল হৃদরোগের ঝুঁকিও হ্রাস করে।
  • অন্যান্য চালের তুলনায় স্থুলতার ঝুঁকিও কম।
  • অনেকের মতে ক্যান্সার প্রতিরোধেও এটি কার্যকর।

রান্নার প্রণালী

প্রথমেই চাল ভালো ভাবে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে চুলায় বসিয়ে দিতে হবে। এককাপ চালের জন্য দিতে হবে ২ কাপ পানি। অনেকে হাড়িতে এক চিমটি লবণ ও কিছুটা তেলও দেন স্বাদের জন্য। এই চালের দানা সাদা চালের তুলনায় শক্ত হয়। তাই ভাত সেদ্ধ হতে অনেকটা সময় নেয়। তবে রান্নার বেশ আগে থেকে যদি চালগুলোকে ভিজিয়ে রাখা যায় তাহলে রান্নার সময় অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

কালো চালের যে শুধু ভাতই হয় তা নয়। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, পায়েশ, খিচুরি, স্যুপ, এমনকি বিরিয়ানিও রান্না করা যায়। তবে রান্না হবার পর স্বভাবতই এই ভাত বেশ আঠালো ধরনের হয়, ঝরঝরে হয় না।

কোথায় পাবেন

আমাদের দেশে কালো চাল বা ব্ল্যাক রাইস এখনো বাজারের সব মুদির দোকানে পাওয়া যায় না। তবে জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই চাল এখন সুপার শপগুলোতে পাওয়া যায়। এছাড়া, অনলাইনেও অনেক ওয়েবসাইট আছে যেখান থেকে এই চাল পেয়ে যাবেন ঘরে বসেই। বিশ্বস্ত যে কোনো মাধ্যম থেকে কিনে নিতে পারেন আপনিও।

মাঝে এই প্রজাতির চাল আমাদের দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু এখন কৃ্ষক এবং কৃ্ষিবিদদের প্রচেষ্টায় এই চাল আবারো পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে কুমিল্লা জেলার অনেক গ্রামে এখন এই কালো ধানের চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতেও এই ধানের চাষ হয়। এটি মূলত আমন মৌসুমে চাষ করা হয়। এই ধান চাষে সাধারন ধানের থেকে আলাদা কোনো পরিচর্যা করার প্রয়োজন পরে না। প্রায় একই রকম সেচ ও সার দিয়েই এই ধান চাষ করা হয়।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত ও চীনে কালো ধানের চাষ হয়। আমাদের দেশে এখন বিদেশি জাতের ব্ল্যাক রাইসেরও উৎপাদন শুরু হয়েছে। যার ফলে আগের তুলনায় কম দামে এখন এই চাল পাওয়া যাচ্ছে। বাইরে এর প্রচুর চাহিদা থাকায় কিছু চাল রপ্তানীও করা সম্ভব হচ্ছে।

কালো চাল শুধু খাদ্যই নয়, এটি একটি পথ্যও বটে। যারা মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে ভাত খেতে পারছেন না তারা এই চালের ভাত খেতে পারেন। তবে শুধু ডায়েটের জন্যই নয়, সুস্থ থাকার জন্য ও বিভিন্ন রোগকে দূরে রাখার জন্যও এই চাল অদ্বিতীয়। অর্থাৎ দেখতে কালো হলেও পুষ্টিগুণ বিবেচনা করলে এই চালই সবথেকে ভালো।

Similar Posts