খেলাফতের ইতিহাস : শুরু থেকে শেষ (শেষ পর্ব)
উসমানীয় খেলাফত (১৫১৭-১৯২৪)
উসমানীয় খেলাফত ছিলো তুরস্কের ইস্তাম্বুলকেন্দ্রিক একটি বিশাল বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আর্তুগ্রুল গাজীর পুত্র উসমান গাজী। তার নামানুসারেই উসমানীয় বা অটোমান খেলাফতের নামকরণ করা হয়েছে। ১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দোর্দন্ড প্রতাপে বৃহৎ এক সাম্রাজ্যের মালিক হলেও তারা খেলাফতের দাবি তোলেনি। তবে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে উসমানীয় শাসকরা খেলাফতের দাবি করতে থাকে। ১৫১৭ সালে কায়রোর আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের পর তারা বৈধভাবে খেলাফতের মসনদে আসীন হয়।
উসমানীয় সাম্রাজ্যে উসমানীয় খেলাফতের গোড়াপত্তন করেন সুলতান প্রথম সেলিম। উসমানীয় সাম্রাজ্যের নবম এই সুলতান প্রথম উসমানীয় খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হন। তার আগের আটজন সুলতান পদে থাকলেও খলিফা ছিলেন না। তিনি মামলুক সাম্রাজ্য জয় করার মাধ্যমে আব্বাসীয় খেলাফত হতে খেলাফতের দায়িত্ব উসমানীয়দের কাছে নিয়ে আসেন। যার ফলে উসমানীয় সালতানাত উসমানীয় খেলাফতরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং সুলতান সেলিম প্রথম উসমানীয় খলিফা হিসেবে “আমিরুল মুমিনীন” উপাধি ধারণ করেন।
শত শত বছর ধরে পৃথিবীর বিপুল অঞ্চল শাসনকারী উসমানীয় সাম্রাজ্য তৎকালীন পৃথিবীর প্রধান পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দীর্ঘ ৬২৫ বছর এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছে মোট ৩৭ জন উসমানীয় শাসক। এর পুরোটা সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে উসমানীয় খেলাফত।
১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের কনস্টান্টিনোপল জয়ের মাধ্যমে উসমানীয়রা ১৫০০ বছরের পুরনো খ্রিস্টীয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে উৎখাত করে। মামলুক সালতানাত জয় করার মাধ্যমে সুলতান প্রথম সেলিম মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে একত্রিত করেছিলেন। যার ফলে মামলুকদের অধীনস্থ মিশর, সিরিয়া, লেভান্ট, হেজাজ, ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন আরব অঞ্চল উসমানীয় খেলাফতের দখলে আসে। ১৫২৬ সালে হাঙ্গেরি জয়ের ফলে ইউরোপের বলকান অঞ্চলসমূহ নিয়ে বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করে উসমানীয়রা। উসমানীয় সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি লাভ করে দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট খ্যাত সুলতান প্রথম সুলাইমানের রাজত্বকালে। তার সময়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে উসমানীয় খেলাফত উত্তরে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর, পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা ও হর্ণ অব আফ্রিকাজুড়ে, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশসমূহসহ বিশাল শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্যরূপে গড়ে উঠে।
উসমানীয় খেলাফতের শাসন পৌঁছে গিয়েছিলো ইউরোপের হাঙ্গেরি থেকে উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া, রাশিয়ার ক্রিমিয়া থেকে পূর্বে জর্জিয়া এবং আরবের ইয়েমেন পর্যন্ত। সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর সময় উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ছিলো প্রায় ৫২০০০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বসে তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, ককেশাস এবং পূর্ব ইউরোপের অনেক গভীর পর্যন্ত শাসন করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ৩৬ টি প্রদেশ এবং অনেকগুলো অনুগত রাজ্য ছিলো। গোড়াপত্তনের উপর ভিত্তি করেই দীর্ঘ ৬২৫ বছর তিন মহাদেশজুড়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসনক্ষমতা পরিচালনা করেছে এই রাজবংশটি। পরিবর্তিত নানা পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারাই ছিলো উসমানীয় সাম্রাজ্যের সফলতার মূল কারণ।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি এসে পাল্টাতে শুরু করে দৃশ্যপট। প্রাচীন রাজনৈতিক প্রথা, ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের অভাব এবং ইউরোপের সাথে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বিষয়ে খাপ খাইয়ে চলতে না পারায় উসমানীয় খেলাফত ইউরোপের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে ব্যর্থ হয় এবং বৃহৎ পরাশক্তির মর্যাদা হারায়। ইউরোপের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও সেক্যুলারিজমের প্রভাব এ সাম্রাজ্যের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। ইউরোপের সাথে প্রতিযোগিতায় ধীরে ধীরে পতন ঘনিয়ে আসে শক্তিশালী এ খেলাফতের।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কিছু জটিল ঘটনা উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ১৯০৮ সালে শক্তিশালী উসমানীয় খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি করে তারই সরকারের তিন পাশা (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যুদ্ধমন্ত্রী ও নৌমন্ত্রী)। তখন থেকে খলিফা শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন, মূল ক্ষমতা থাকতো সামরিক কর্মকর্তা ও আমলাদের হাতে।
উসমানীয় খেলাফতের পতন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি এবং তাদের মিত্র আরব জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহীদের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে। তাদের পতনের পিছনে নানা কারণ থাকলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধই মূলত এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। উসমানীয়রা ইউরোপের নানা দেশের কাছে বিশাল অঙ্কের ঋণের দায়ে আবদ্ধ ছিলো, যা তারা পরিশোধে অক্ষম ছিলো। এই ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তারা। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে উসমানীয় খেলাফত অক্ষশক্তির পক্ষে বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে প্রবেশ করে এবং তাতে অক্ষশক্তির পরাজয়ের ফলে তারা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের শেষ নাগাদ উসমানীয়রা দৃশ্যত তাদের সমগ্র সাম্রাজ্য হারায়। উসমানীয় খেলাফতের পতন ঘটিয়ে নতুন নতুন জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনী। তাকিয়ে দেখা ছাড়া উসমানীয়দের তখন আর কিছুই করার ছিলো না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক তুরস্ক গঠিত হয়। উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো প্রায় ৪৯ টি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের ফলে তুরস্কে গঠিত হয় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর কামাল পাশা তুর্কি সালতানাত বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। তখন সালতানাত বিলুপ্ত হলেও খেলাফত বহাল রাখা হয়। তৎকালীন সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার ভাই দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে খেলাফতের আসনে বসানো হয়। নামেমাত্র খলিফা বানানো হলেও তার হাতে দেওয়া হয়নি কোনো ক্ষমতা।
ক্ষমতায় বসেই আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে সংস্কার শুরু করেন। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি খেলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ শেষ উসমানীয় খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে ফ্রান্সে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী উসমানীয় খেলাফত বিলুপ্তির পাশাপাশি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মৃত্যুর পর থেকে চলে আসা খেলাফতব্যবস্থারও চূড়ান্ত বিলুপ্তি ঘটে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।