ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী- বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম (১ম পর্ব)

চট্টগ্রামকে বলা হয় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের দক্ষিণ- পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরটি বন্দর নগরী নামে পরিচিত। পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা ইত্যাদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই শহরটি প্রাচ্যের রাণী হিসেবেও বিখ্যাত। এটি আমাদের দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর । ঢাকার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু, চট্টগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো, প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি। এক সময়ের আরব বন্দর, আরাকানিদের ঘাঁটি, পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি এ শহর। তারপর এসেছিলো ব্রিটিশরা । ভারতের মুম্বাইয়ের আগে নির্মিত হয়েছিলো চট্টগ্রাম বন্দর। ২০১৪ সালের মে মাসে হওয়া এক সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিম বঙ্গের কলকাতা শহরের অর্থনীতি এবং চট্টগ্রাম শহরের অর্থনীতি প্রায় সমান। এই শহর দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ম বৃহৎ অর্থনীতির শহর । এমন সম্ভাবনাময় এবং ইতিহাস খ্যাত শহর সম্পর্কে আজ আমরা বিস্তারিত জানবো। জানবো এই শহরের নানাবিধ বিষয়, ইতিহাস, সংগ্রাম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, বহুমুখী সম্ভাবনা ও তা পুনরুদ্ধারে করণীয় সম্পর্কে।

chittagong-witness-to-history-and-tradition
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম

জাতীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । এর থেকে চট্টগ্রামের অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা যায় । এতে বলা হয়েছে- ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের রাজা সু- লা- তাইং- সন্দয়া চট্টগ্রাম অভিযানে আসেন । কোনো এক অজানা কারণে তিনি বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেন নি । তাই তিনি একটি স্তম্ভ তৈরি করেন । এর ফলকে তিনি লিখেছিলেন- ‘চেৎ- ত- গৌঙ্গ’। যার অর্থ হলো ‘যুদ্ধ করা অনুচিত’। তখন থেকে এই এলাকা ‘চৈত্তগৌং’ নামে পরিচিত হয়েছে বলে জানা যায় । আরাকানি পুঁথি ‘রাজাওয়াং’-এও এর প্রমাণ পাওয়া যায় । উক্ত ‘চৈত্তগৌং’ নাম থেকেই পরবর্তীতে ভাষার উচ্চারণের সহজীকরণের স্বাভাবিক ধারায় চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি নাম সৃষ্টি হয়েছে ।

বাংলার ইতিহাসে চট্টগ্রাম নানাভাবে জড়িত। পর্তুগিজরা ১৫১৭ সাল থেকে চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে । প্রাথমিকভাবে তারা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসলেও পরবর্তীতে জলদস্যুতার বিষয়টি তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠে । বাংলার তৎকালীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ পর্তুগিজদের দমনের চেষ্টা করেন । কিন্তু আফগান শাসক শের শাহ চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে দখলে নিবেন- এমন সংবাদ শুনে ভয় পেয়ে যান বাংলার সুলতান । তাই তিনি পর্তুগিজদের কাছে সহায়তা চান । সামরিক সহায়তার বিনিমযে পর্তুগিজরা ১৫৩৭ সালে চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে এবং চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে । ১৫৮১ সালে চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যায় । এ সময় পর্তুগিজদের জলদস্যুপনার কারণে বাধ্য হয়ে আরাকানের রাজা ১৬০০ সালের কিছু পরে শক্ত হস্তে পর্তুগিজদের দমন করেন । ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে সুবেদার শায়েস্তা খান ও তার পুত্র উমেদার খানের নেতৃত্বে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানিদের সাথে মুঘলদের যুদ্ধ হয় এবং মুঘলরা উক্ত যুদ্ধে জিতে যায় । এরপর চট্টগ্রাম মুঘল রাজাদের অধীনে চলে আসে । মুঘল শাসনামলে বিভিন্ন বিদেশি শক্তি বহুবার চট্টগ্রাম শহর এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দখলের চেষ্টা করে । তবে তারা সফল হয়নি । নবাবি শাসনামলে ইংরেজরাও চট্টগ্রাম বন্দরের বহুমুখী সম্ভাবনায় আকৃষ্ট হয়ে এটি দখল করতে চেয়েছিলো । তবে তারা সফল হয়নি ।

স্বজন ও রাজ কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্মম পরাজয় ঘটে । ইংরেজরা পুতুল- নবাব হিসেবে মীর জাফরকে নিযুক্ত করে । কিন্তু মীর জাফরও চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতে দিতে রাজি হয় নি । ফলস্বরূপ মীর জাফরকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে ইংরেজরা ১৭৬১ সালে মীর কাশিমকে নবাব নিযুক্ত করে । এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়ে ইংরেজদের ষড়যন্ত্র সফল হয়।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে চট্টগ্রামবাসীর উপর অনেক বেশি পরিমাণে কর আরোপ করা হয় । চাকমা সহ বিভিন্ন উপজাতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদাররা সময়ে সময়ে বিদ্রোহ করলেও ইংরেজরা তা দমন করতে সফল হয় । আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে ইংরেজরা গোলা- বারুদের গুদামে পরিণত করে। দিনে দিনে চট্টগ্রামের মানুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে । ১৮৫৭ সালে পুরো ভারত বর্ষ জুড়ে হওয়া সিপাহী বিপ্লবের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে ।

এক সময় পুরো ভারত বর্ষ জুড়েই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় । এই আন্দোলনে চট্টগ্রামও পিছিয়ে ছিলোনা । ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় । মাস্টারদা সূর্যসেনের বাহিনী কিছু দিনের জন্য হলেও চট্টগ্রাম এলাকা থেকে ব্রিটিশ শাসনকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো । এই বিপ্লবী বাহিনী চট্টগ্রামে আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয় । চট্টগ্রামের নন্দন কাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিসে আক্রমণ করে, ভাংচুর করে । ফলে আক্ষরিক অর্থেই সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় উক্ত বাহিনী অস্ত্রাগার লুট করে এবং অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে দামপাড়ায় অবস্থিত পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয় । বিপ্লবী বাহিনী দামপাড়ার পুলিশ ব্যারাকে মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে এবং বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করে। পরবর্তীতে ইংরেজদের জোরালো আক্রমণের মুখে এই বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি । সূর্যসেন সহ অনেক বিপ্লবীকেই ইংরেজ সরকার গ্রেফতার করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয় । অনেক বিপ্লবী ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে আত্মহত্যা করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও চট্টগ্রাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা খবর, সংবাদ ও সংকেত প্রচার করা হতো । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চট্টগ্রাম থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচার করেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান । চট্টগ্রামে রয়েছে বহু সংখ্যক বধ্যভূমি । চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন বহু মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা কবি, সাহিত্যিক প্রমুখ ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র।

ঐতিহাসিক বহু ঘটনার পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়েও চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে । বিভিন্ন সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা শাসক গোষ্ঠী ও বণিক গোষ্ঠীদের কারণে এখানকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক অভূতপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে । ফলে বৈচিত্র্যময়তায় অনন্য হয়ে উঠে এখানকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি । চট্টগ্রাম এক সময় আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যাওয়ায় আরাকান রাজ্যের রাজসভায় চট্টগ্রামের বাসিন্দারা স্থান পায়। আরাকান রাজ্যের রাজসভায় বিখ্যাত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের অনেক কবি । দৌলত কাজী, কবি মরদন, মহাকবি আলাওল প্রমুখ কবি চট্টগ্রামের সন্তান । তাঁরা আরাকান রাজসভায় নিজ দক্ষতায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন ।

মধ্যযুগেও চট্টগ্রামে বহু কবি, সাহিত্যিক ও লেখক জন্মগ্রহণ করেন । কবি শাহ মোহাম্মদ ছগির, দৌলত উজির বাহরাম খান, সৈয়দ সুলতান, কাজী হাসমত আলী, সাবিরিদ খান, শেখ পরান, রহিমুন্নেসা, মুহম্মদ মুকিব প্রমুখ কবি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন মধ্যযুগের সাহিত্য চর্চায়, যাঁরা সবাই চট্টগ্রামের সন্তান । পরবর্তীতে কবি আবদুল হাকিম, ভবানী শঙ্কর দাস, নবীনচন্দ্র সেন, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখ কবি ও লেখক সাহিত্যে অবদান রাখেন । আধুনিক যুগের সাহিত্যে মাহাবুব উল আলম, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, ডক্টর আবদুল করিম, আহমদ শরীফ, আবদুল হক চৌধুরী, আহমদ ছফা, সুকুমার বড়ুয়া, আব্দুল হাকিম প্রমুখ ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন । তাঁরা সকলেই চট্টগ্রামের সন্তান। তাঁরা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন ।

(চলবে)

Similar Posts