গণিতের চর্চায় অ্যাবাকাস থেকে ক্যালকুলেটর- ২য় পর্ব

(গত পর্বের পরে …)

১৮২০ সালের দিকে আবিষ্কার হওয়া ‘এরিথমোমিটার’ কিংবা এর আগের যান্ত্রিক ক্যালকুলেটরগুলো খুব সহজে বহনযোগ্য ছিলো না । ১৮৭৭ সালে ‘Grant Mechanical Calculating Machine’ নামক তুলনামূলক সহজে বহনযোগ্য এবং হস্তচালিত একটি ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করা হয় । যা উইলিয়াম সিউয়ার্ড ১৮৮৬ সালে আরো উন্নততর রূপে P100 Burroughs Adding Machine নামক ক্যালকুলেটর হিসেবে ইমপ্লিমেন্ট করেন। ১৮৮৭ সালে ডর ফেল্টস নামক এক ব্যক্তি আমেরিকাতে ‘কম্পটোমিটার’ নামক একটি ক্যালকুলেটরের পেটেন্ট করেন । এই ক্যালকুলেটরটির মাধ্যমে ‘Push Button Age’ তথা বোতাম যুক্ত ক্যালকুলেট যুগের সূচনা হয় ।

from-abacus-to-calculator

১৯৩৮ সালে ‘কার্টা ক্যালকুলেটর’ নামক আরেকটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করা হয় । যা আকারে পূর্বের সকল ক্যালকুলেটর থেকে ছোট, মানুষের পকেটেই বহনযোগ্য । এটিও গণিতের চার প্রক্রিয়া তথা যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগের কাজ করতে পারতো ।

‘কার্টা’ মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটর। ছবি: Imgur.

যান্ত্রিক যুগের পর ইলেকট্রনিক্স যুগে ক্যালকুলেটরকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় । এর অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালে ANITA (পূর্ণরূপ হলো : A New Inspiration To Arithmetic/ Accounting) নামক ক্যালকুলেটর আবিষ্কৃত হয় । এটি বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক্স ক্যালকুলেটর । ব্রিটেনের ‘কন্ট্রোল সিস্টেম লিমিটেড’ এই যন্ত্রটি তৈরি করে । এটিও ‘পুশ বাটন’ বা বোতাম চালিত ক্যালকুলেটর । তবে বোতাম ছাড়া যন্ত্রের অন্য সকল অংশ ইলেক্ট্রনিক্স পদ্ধতিতে অর্থাৎ ভ্যাকুয়াম এবং ক্যাথড টিউবের সমন্বিত কৌশলে নিয়ন্ত্রিত হতো ।

ট্রানজিস্টর আবিষ্কার হওয়ার পর ক্যালকুলেটরের আরো উন্নত ধরন আবিষ্কার হয় । ১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত Olivetti Programma 101 যন্ত্রটিও একটি ট্রানজিস্টর নিয়ন্ত্রিত ক্যালকুলেটর । এটি ম্যাগনেটিক কার্ডে ইনপুট এবং আউটপুট লিখতে পারতো । একই সাথে সংযুক্ত প্রিন্টারে আউটপুট প্রিন্ট করতে পারতো । তবে এ ধরনের ক্যালকুলেটর ব্যয়বহুল এবং আকারে বড় হওয়ায় খুব একটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি ।

অ্যাবাকাসের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করতে মানুষের সময় লেগেছে প্রায় ৩৭০০ বছর । তারপর আরো প্রায় আড়াইশো বছর লেগেছে ইলেকট্রনিক্স ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করতে । এরপরে আরও কয়েক যুগ লেগেছে সহজে বহনযোগ্য ও সহজলভ্য এবং ইউজার এফিশিয়েন্ট ক্যালকুলেটর তৈরি করতে ।

মাইক্রো চিপ এবং সেমি কন্ডাক্টর যুগে এসে মানুষ আরো উন্নত ক্যালকুলেটর তৈরি করেছে । লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেশান বা এল. এস. আই সেমি কন্ডাক্টর এবং পদ্ধতিগত নানা কৌশল ব্যবহার করে আমেরিকান এবং জাপানি বিভিন্ন কোম্পানি ক্যালকুলেটর বানাতে থাকে । ক্যানন, ইন্টেল সহ শীর্ষস্থানীয় অনেক কোম্পানি এমন আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে বাণিজ্যিকভাবে ক্যালকুলেটর বানাতে শুরু করে । ধীরে ধীরে ক্যালকুলেটরগুলোতে ট্রানজিস্টর সংখ্যা বাড়ানো হয় । নানা কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যালকুলেটরগুলোর গাণিতিক হিসাব- নিকাশের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় ।

১৯৭০ সালে জাপানি কোম্পানি ‘বুসিকম’ ‘Busicom LE-120’ নামক একটি ছোট ক্যালকুলেটর তৈরি করে । এটি গণিতের চার প্রক্রিয়া এবং দশমিকের হিসাব নিকাশ করতে পারতো । এটিকে প্রথম আদর্শ পকেট ক্যালকুলেটর বলা হয় । কিছুদিনের মধ্যেই এই ক্যালকুলেটরটিকে আকারে আরো ছোটো করে ফেলা হয় ।

কিছু বছরের মধ্যেই ‘সিনক্লেয়ার’ কোম্পানি প্রতিযোগিতামূলক দাম অপেক্ষা কম দামের ক্যালকুলেটর বাজারজাত করে । ১৯৭২ সালে এইচ. পি কোম্পানি ছোট আকৃতির একটি পকেট ক্যালকুলেটর তৈরি করে । এর নাম ছিলো Hewlett HP-35, এটি হলো প্রথম সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর । এতে ত্রিকোণমিতি এবং বীজগণিতের বিভিন্ন ফাংশন সমাধান করা যেতো । এর মধ্যেই ক্যালকুলেটরগুলোকে ‘Programmable’ করে তৈরি করা শুরু হয়, যেগুলো বিশেষ ধরনের ইনপুট গ্রহণ করতে পারতো ।

১৯৭৪ সালে এইচ. পি. কোম্পানি HP-65 নামক একটি ক্যালকুলেটর তৈরি করে । এতে প্রায় ১০০ ধরনের ইন্সট্রাকশান দেয়া যেতো । বিল্ট ইন ম্যাগনেটিক কার্ডে ইনপুট- আউটপুট দেখানোর পাশাপাশি এগুলোকে জমা রাখা, প্রোগ্রাম করা ইত্যাদি কাজও করতে পারতো এই ক্যালকুলেটর ।

এরপর প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে ক্যালকুলেটরকে আরো আধুনিক ও অভিনব যন্ত্র হিসেবে তৈরি করা হয় । বর্তমানে কম্পিউটারে ও বিভিন্ন আইসিটি ডিভাইসে ক্যালকুলেটরের ভার্চুয়াল ভার্সন ব্যবহৃত হয় ।

অ্যাবাকাস থেকে শুরু করে গণনা করার জন্য যুগে যুগে মানুষ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করেছে । সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্যালকুলেটরকে আবিষ্কার করেছে নতুন রূপে । এই ধারাবাহিকতা চলমান রয়েছে, চলমান থাকবে । প্রযুক্তির এরূপ অগ্রযাত্রায় অংশ নিয়ে আগামীর প্রজন্ম আরো নতুন, চমৎকার ও বিস্ময়কর আবিষ্কার করে যাবে – এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা ।

(সমাপ্ত)

Similar Posts