বইমেলায় গমন : যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত

বইমেলা যেন সকল লেখক ও পাঠকের প্রাণের মেলা। বইপ্রেমীরা সুদীর্ঘ এক বছর ধরে এই বইমেলা হওয়ার অপেক্ষা করে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে বইমেলা নিয়ে অনেক কথাই উঠেছিল। বেশ কয়েকবার ধারণা করা হয়েছিল এবার ভার্চুয়াল বইমেলা সংঘটিত হবে। কিন্তু পাঠকদের মনের অবস্থাটা বোঝার কারণেই কি-না অথবা অন্য কোনো কারণে বইমেলা অন্যান্য বছরের মতো এবছরও স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছে। বই মেলায় যাওয়ার আনন্দটা অনুভব করার জন্য ছোটো বড়ো সকলেই ছুটে চলছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বইমেলা শুরু হওয়ার লগ্ন থেকে বই কিনে বোঝাই হাতে করে বাড়িতে ফিরে আসার আনন্দটা যেন সত্যিই অপূর্ব। আর করোনাকালীন এই আনন্দটা অনুভব করা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারে নি বিধায় আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।

কিন্তু উত্তেজিত হয়ে অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন যে করোনার অস্তিত্ব এখনো চলে যায়নি। বরং করোনার মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ে বই মেলায় যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন সরকার। সুতরাং বইমেলায় যখন যেতেই হবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নেওয়া আবশ্যক। অন্যথায় জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে।

বই মেলায় আপনার ভ্রমণকে আরো সার্থক ও প্রাণবন্ত করতে হলে কিছুটা পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়ে নেওয়া ভালো এবং সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে কিছু করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয় রয়েছে। চলুন, দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক বই মেলায় যাওয়ার পূর্বে এবং সেখানে অবস্থানরত অবস্থায় আপনার করণীয় এবং বর্জনীয় কাজগুলো কি কি।

বইয়ের তালিকা তৈরি করা

যেহেতু আপনি বই মেলায় যাচ্ছেন সুতরাং আপনার কোন না কোন বই কেনার ইচ্ছে অবশ্যই রয়েছে। যদি আপনি বইপ্রেমী নাও হন তবুও বই মেলায় গিয়ে হয়তো খালি হাতে বাড়িতে ফিরে আসবেন না। সুতরাং আপনার যে কাজটা করতে হবে সেটা হল, বই মেলায় যাওয়ার পূর্বে পছন্দের বইয়ের তালিকা ও দাম গুলো সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। উক্ত বইগুলো কোন প্রকাশনীতে পাওয়া যাবে সে সম্পর্কেও ধারণা নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে বই খুঁজতে বেশ অসুবিধা হবে।

ছোট সদস্যদের বোঝানো

বইমেলায় নারী-পুরুষ-শিশু বৃদ্ধ সকলেই যেতে চায়। পরিবারের সব থেকে ছোট সদস্যরাও বইমেলায় যাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। কিন্তু যেহেতু তারা বয়সে ছোট হয়ে থাকে, তাই তাদের সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় বাড়ির বড়দের। অবশ্যই শিশুদের বই মেলায় নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই করবেন। বইয়ের সাথে খুব কম বয়স থেকে পরিচয় না ঘটালে তারা বড় হয়ে বই এর মর্ম বুঝতে পারবে না এবং পথভ্রষ্ট প্রজন্মের মত মোবাইল এডিক্টেড হয়ে যাবে। সুতরাং ছোটদের অবশ্যই বইমেলায় নিয়ে যাবেন তবে সাবধানতার সাথে। তাকে পূর্বেই জানিয়ে দেবেন সে যেন সেখানে গিয়ে আপনার হাত না ছাড়ে এবং কোন বই পছন্দ হলে আপনাকে ভালোভাবে জানায়। আর করোনা কালীন এই বইমেলায় তাদের না নিয়ে যাওয়াই উত্তম।

গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাড়িতে রেখে যাওয়া

আপনি যদি একাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, সেইসাথে ক্রেডিট কার্ড মানি ব্যাগে নিয়ে ঘুরেন, এই ক্ষেত্রে আপনার করণীয় এসকল জিনিস বাড়িতে রেখে যাওয়া। কারণ বইমেলা এমন একটা জায়গা যেখানে অনেক ভিড় হয়ে থাকে এবং এই ভীড়ের সুযোগে কিছু চোর পকেটমাররা খুব সহজেই আপনার গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি করে নিতে পারে। তাই বই মেলায় যাওয়ার পুর্বে আপনার উচিত অতিরিক্ত টাকা পয়সা না নেওয়া। বরং বইয়ের দাম, যাতায়াতের খরচ, খাবারের খরচ এই সকল খরচ বাবদ রেখে বাকি টাকা রেখে যাওয়া। সেইসাথে ক্রেডিট কার্ড বাড়িতে রেখে গেলেও ভালো হয় এবং একাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে সব থেকে কম দামি মোবাইল ফোনটা নিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত। এছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যা আপনি ব্যবহার করে থাকেন সেগুলো বইমেলায় না নিয়ে যাওয়াই ভালো।

আরামদায়ক পোশাক

যেহেতু বই মেলা প্রাণের মেলা এবং একইসাথে বছরে মাত্র একবার অবস্থান করে তাই এই জায়গাটায় সকলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে যেতেই পছন্দ করে থাকেন। যেমন এখানে পুরুষেরা পাঞ্জাবি, নারীরা শাড়ি এবং শিশুরাও তাদের বয়সের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরে বইমেলায় যেতে চায়। করোনাকালীন বইমেলা যে মাসে পড়েছে সেই মাসে প্রচুর গরম। আর এই গরমে আপনি আপনার ভারী জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক সামলাবেন না-কি বই দেখবেন এই বিষয়টা ভাবতে গিয়ে আপনার অনেক সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তাই সবথেকে ভালো হয় আরামদায়ক কোন পোশাক পড়ে মেলায় যাওয়া। যাতে আপনি স্বাচ্ছন্দে বই দেখতে পারেন।

কোন স্টলে ভিড় না করা

আপনি যদি বই কিনার উদ্দেশ্যে বইমেলায় গিয়ে থাকেন তবে যেন আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে প্রকাশনীর বিভিন্ন স্টলে ভিড় সৃষ্টি না করা। মনে রাখবেন আপনার মত শত শত পাঠক এই মেলায় এসেছে বই কেনার জন্য। সুতরাং প্রকাশনী স্টল থেকে আপনার যখন বই কেনার কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে, তখন আপনি দ্রুততার সাথে সেই স্টল ত্যাগ করবেন এবং আপনার আশেপাশে অপেক্ষারত পাঠকদের সুযোগ করে দেবেন বই কেনার। অযথাই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দাঁড়িয়ে থেকে কোন গণ্ডগোল সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকবেন।

বই নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা

বইপ্রেমীদের আকৃষ্ট করার জন্য স্টলের প্রকাশক ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা ডিসপ্লের জন্য কিছু বই সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু আপনার যদি ওই বইগুলো কেনার সামর্থ্য অথবা ইচ্ছে না থাকে তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন বই নিয়ে হাতাহাতি না করার। এতে করে আপনি সেখানকার সাজানোর সৌন্দর্যের ওপর বিশৃংখলা সৃষ্টি যেমন করবেন ঠিক তেমনি আপনার কাজে বিরক্ত হয়ে প্রকাশক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কষ্ট পেতে পারে। সুতরাং কোনো বই না কেনার ইচ্ছা থাকলে চেষ্টা করবেন সেখানে বিশৃংখলা সৃষ্টি না করতে।

ব্যাগ ও ছোট সদস্যদের সামলে রাখা

বইমেলা অনুষ্ঠিত হলে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঠক-পাঠিকারা ছুটে আসে বই কেনার উদ্দেশ্যে। তাই এই মেলায় একটু বেশিই ভিড় হয়। এই ভিড়ের মধ্যে আপনজন হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন চুরি করার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। সুতরাং বই দেখার পাশাপাশি ছোট সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বোঝাই ব্যাগ সামলে রাখার দিকেও আপনার লক্ষ্য রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রের ব্যাগ কিংবা ছোট সদস্য এই দুটোর একটাও হারিয়ে যাওয়া আপনার জন্য অবশ্যই খুব সুখের হবে না। তাই এই কথাটা মাথায় রেখে উভয়কেই সামলে রাখবেন।

কেউ হারিয়ে গেলে মাইকিং করা

বইমেলায় মাইকিং করার ব্যবস্থা থেকে থাকে। এই মাইকিং ব্যবস্থায় সাধারণত সর্বক্ষণ নতুন বইয়ের প্রচার করা হয়। কিন্তু কেউ হারিয়ে গেলেও হারানো বিজ্ঞপ্তি নিয়েও এই মাইকিং ব্যবস্থা প্রচার করে থাকে। সুতরাং আপনার পরিবারের কোনো সদস্য বিশেষ করে ছোট সদস্য যদি মেলায় হারিয়ে গিয়ে থাকে তবে দেরি না করে এই মাইকিং ব্যবস্থার শরণাপন্ন হয়ে যাবেন। সেই সাথে বাড়ির ছোট সদস্যদের আগে থেকেই এই মাইকিং ব্যবস্থার কথা ভালো করে বুঝিয়ে নিবেন যাতে করে দুর্ভাগ্যবশত যদি মাইকিং ব্যবস্থায় তাদের নাম উচ্চারিত হয় তবে তারা যেন দেরি না করে সরাসরি শব্দের উৎস খুঁজে কেন্দ্রে চলে আসে।

টাকা পরিশোধে সাবধানতা

বইয়ের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে যখন আপনি ব্যাগ কিংবা মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করবেন তখন অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করবেন। যেন আপনার টাকা হাত ফোসকে মাটিতে পড়ে না যায়। কেননা ভিড়-বাট্টায় টাকা পড়ে গেলে ওঠাতে গেলে বাঁধতে পারে নানা রকমের বিপত্তি। তাই টাকা পরিশোধ করার সময় অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পরিশোধ করবেন।

লেখকদের বিব্রত না করা

বইমেলায় যেহেতু লেখক-পাঠকের মিলনকেন্দ্র হয়ে থাকে সুতরাং আপনার প্রিয় লেখক এর সাথে দেখা হয়ে যেতেই পারে। তবে তাকে এমন অবস্থায় ফেলবেন না যাতে করে তিনি বিব্রত হয়ে যান। একই সাথে তার অতিরিক্ত সময় নষ্ট করার চেষ্টাও করবেন না। অটোগ্রাফ এবং ছবি তুলতে হলে তার অনুমতি নিয়ে তুলুন। কাজ শেষ হলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান।

প্রিয় পাঠক, আশা করা যায় আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ে বই মেলায় প্রবেশ করবেন। উপরোক্ত নিয়মগুলো মেনে চলবেন এবং পছন্দের বইগুলো কিনতে সক্ষম হবেন। শুভ হোক আপনার বই মেলার যাত্রা।

Similar Posts