চোখ লাফানো ও সচেতনতা
বাম চোখটা হঠাৎ লাফানো শুরু করলে বুকের ভেতরটা নিজের অজান্তে আচমকা কেঁপে উঠে তাই না? এই বুঝি অশুভ কিছু হয়ে গেলো। সারাদিন মনটা উশখুশ করতে থাকে। এমতাবস্থায় যদি হাত থেকে ভুল করে কাঁচের গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। সামান্য একটা গ্লাস ভাঙাকেও তখন অশুভ মনে করা হয়। অথচ ব্যাপারটা নিতান্তই সামান্য। কেননা এই ঘটনা চোখ না লাফালেও হতে পারতো। তখন কিন্তু আর এই ব্যাপারটাকে অশুভ মনে করা হতো না।
কথাটা এখানেই। চোখ লাফানো শুরু করলেই আমাদের মনে দাদী নানির বিশ্বাস করা কুসংস্কারটা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চোখ লাফানোর সাথে ভাগ্যের ভালো-মন্দের কোনো সংযোগ নেই। চোখ লাফানো নিতান্তই একটি শারীরিক ব্যাপার। কিন্তু অনেকে জানেন না চোখ কেন লাফায়। তাই চোখ লাফানো শুরু করলে তাদের মনে ভয় জেগে উঠে। তারা ভাবেন খারাপ কিংবা ভালো কিছু হতে চলেছে। এ বিষয়টা পরিষ্কার করে দিয়ে ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্যই আজকের এই লেখা।
চোখের পাতা লাফানো আসলে কি?
মূলত চোখের পাতা লাফানো একধরনের অসুখ। তবে এটি যন্ত্রণাদায়ক না কিন্তু অস্বস্তিকর। এই অসুখকে ডাক্তারী ভাষায় মায়োকিমিয়া বলে। মূলত পেশির অবিরাম সংকোচনের কারণেই চোখ লাফায়। একে আইলিড টিক্স অথবা আই স্পাজমও বলে। আপনার চোখের পাতা লাফানো আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না যতক্ষণ না কেউ আপনার চোখের পাতা স্পর্শ করে।
কি কারণে চোখের পাতা লাফায়?
নিম্নে কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করছি যার জন্য চোখের পাতা সচরাচর লাফিয়ে থাকে। আশা করি এর কারণ জানতে পারলে অনেকে কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসবেন।
*আমাদের মস্তিষ্ক যখন খুব কঠিন মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যায় তখন আমাদের শরীর বিভিন্ন উপায় তার প্রতিক্রিয়া দেখায়। উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেরদিন ফলাফলের কথা সারাদিন মাথায় ঘুরতে থাকে। নিজের অজান্তেই দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। এসময় প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী কঠিন মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যায়। এই মানসিক চাপের জন্য তাদের চোখ লাফানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদি চোখ লাফিয়ে থাকে তার মানে এই নয় যে এটা পরীক্ষার ফলাফল কি হবে তার পূর্বাভাস। বরং এটা দুশ্চিন্তার একটি প্রকাশ মাত্র।
* ঘুমের অভাব ও ক্লান্তির কারণেও এটি হয়ে থাকে। ঠিকমতো ঘুম ও ক্লান্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
* দৃষ্টিতে সমস্যা থাকলেও এটি হয়ে থাকে
* মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভির আলো চোখে প্রবেশ করলে অনেক সময় চোখে চাপ পড়ে। এই চাপের জন্যও চোখ লাফিয়ে থাকে
* বিভিন্ন কারণে চোখ শুকিয়ে যায়। টিভির স্ক্রিনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে, বয়সজনিত কারণে কিংবা কন্টেক্ট লেন্স ঠিক মতো না পড়লেও চোখ শুকিয়ে যেতে পারে। অনেক সময় চোখ শুকিয়ে যাওয়ার কারণেও চোখ লাফাতে পারে
* পুষ্টির অভাব কিংবা ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে। বিশেষ করে ম্যাগনেসিয়ামের অভাব ঘটলে
* এলার্জি জনিত কারণে আঙুল দিয়ে চোখ ঘষলে চোখের পানির সাথে হিস্টামিন নামের এক পদার্থ বের হয় যাকে চোখের পাতা লাফানোর জন্য দায়ী করা হয়
* কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে অতিরিক্ত ক্যাফেইন ও আ্যলকোহল জাতীয় কিছু সেবনে চোখের পাতা লাফাতে পারে
চোখের পাতা লাফানো বা আই স্প্যজাম থেকে পরিত্রাণের উপায়-
সাধারণত এটা তেমন বড় অসুখ না কিন্তু অনুভূতিটা বড়ই অসহ্যকর। তাই এই সমস্যা যাতে না হয় তাই কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে।
*নিয়মিত পুষ্টি সম্মত খাওয়া দাওয়া করা
*বেশি পানি পান করা
*নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম
*আ্যলকোহল ও ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় কম পরিমাণে পান
*কোনো ডিভাইসের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবে না কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন হলে প্রতি দশ মিনিট পর পর কমপক্ষে ১০-১৫ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রাখতে হবে
*মানসিক চাপকে সহজ ভাবে নিতে হবে
*ধুলাবালি থেকে চোখকে বাঁচানোর জন্য চশমা ব্যবহার করতে হবে
কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে কি?
হ্যাঁ। চোখ লাফানো কখনো কখনো অনেক রোগের লক্ষণও হয়ে থাকে।
*ফেসিয়াল পালসি
*পারকিনসন ডিজিজ
*মাল্টিপাল স্কেলিরোসিস ইত্যাদি
তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চোখ লাফানো চোখের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে?
হুট করে চোখের পাতা লাফানো কোনো বড় বিষয় না। এটি যেমন হুট করে শুরু হয়েছে তেমনি হুট করে থেমে যাবে। তবে যদি দীর্ঘক্ষণ হয়ে থাকে তবে কোনো অশুভ কিছুর জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অন্যথায় সত্যি সত্যি অশুভ কিছু হয়ে যাবে আপনার সাথে।
এছাড়াও চোখ লাল হয়ে গেলে, ফুলে গেলে, পানি বের হলে, পাতা বারবার পড়তে থাকলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
আশা করি এই লেখাটি পড়ে আপনারা চোখ লাফানো সম্পর্কে অনেক কিছুই বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। তাই চেষ্টা করবেন চোখ লাফানো জাতীয় যেসব কুসংস্কার আছে তা অবিশ্বাস করতে। এতেই আমার লেখা সার্থক হবে। ধন্যবাদ।