ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী- বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম (২য় পর্ব)

চট্টগ্রামের রয়েছে সুপ্রাচীন ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য । চট্টগ্রামের মানুষ ভোজন রসিক হিসেবে পরিচিত । আতিথেয়তার জন্যও চট্টগ্রাম অনেক জনপ্রিয় । তারা যেমন নিজেরা খেতে পছন্দ করেন, তেমনি অতিথি আপ্যায়নেও সেরা । চট্টগ্রামে মেজবান খুবই বিখ্যাত। সাদা ভাত, চনার ডাল ও গরুর মাংস দিয়ে আয়োজন করা হয় এই মেজবান । চট্টগ্রামে যেরকম সমারোহ ও আমেজ নিয়ে মেজবান অনুষ্ঠান হয়, তেমনটা আর কোথাও হয় না । বিয়ে, জন্মদিন সহ সামাজিক যেকোনো উপলক্ষে চট্টগ্রামে মেজবান অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রচলন রয়েছে । শুঁটকি, মধুভাত, জর্দ্দাভাত, বেলা বিস্কুট, বাকরখানি, গরুর গোস্ত ভুনা, মেজবানি মাংস, কালাভুনা, বিরিয়ানি, তাল পিঠা ইত্যাদি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ।

১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর চট্টগ্রামে সংস্কৃতির ধারা কিছুটা পরিবর্তন হয় । তখন পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই ধান উৎপাদন ও বণ্টনে পদ্ধতিগত আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় । অন্যান্য স্থানের মতোই চট্টগ্রামেও একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয় । এর মধ্যেই ইংরেজরা ইংরেজি শিক্ষা প্রচলন করে এবং এর ব্যাপক প্রসার ঘটায় । মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয় এবং পাশ্চাত্যের সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করে । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কারণে তখন সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং অনেক কুসংস্কার ও সামাজিক গোঁড়ামি দূর হয়ে যায় । তবে পাশ্চাত্য ধাঁচের প্রভাবে বহু অপসংস্কৃতিও প্রবেশ করে।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান অনেক ঐতিহ্যময় ও বিখ্যাত। শেফালী ঘোষ কে বলা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী এবং শ্যাম সুন্দরকে বলা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট । বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবদুল গফুর হালী গীত দরিয়া বা গানের সাগর নামে পরিচিতি পান । তিনি অসংখ্য আঞ্চলিক গান ও মাইজভান্ডারী গান রচনা করেন । চট্টগ্রামের সন্তান কবিয়াল রমেশ শীল একজন বিখ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী । কবিয়াল, আঞ্চলিক, ভাটিয়ালি ও মাইজভান্ডারী গান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য । আধুনিক যুগের বহু জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ব্যান্ড দলও চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে।

নানা লোকজ উৎসবেও চট্টগ্রাম বৈচিত্র্যময় । চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভূক্ত পার্বত্য জেলাগুলোতে বাস করে নানা ধরনের উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী । তাদের রয়েছে নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচার ও নানা ধরনের উৎসব । প্রতি বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটা করে মহা সমারোহে বৈসাবি উৎসব পালন করা হয় । ত্রিপুরাদের প্রধান উৎসব বৈসু বা বৈসুব, মারমাদের প্রধান উৎসব সাংগ্রাই, চাকমাদের প্রধান উৎসব বিজু । এই তিনটি প্রধান আদিবাসী সমাজের প্রধান উৎসবগুলোর নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে গঠিত হয়েছে ‘বৈসাবি’ নামটি । মূলত এই তিনটি উপজাতি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উৎসব বৈসাবি । এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে । এই উৎসব উপলক্ষে আদিবাসীরা নানা ধরনের খেলাধুলা, মেলা, পানি উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে ।

চট্টগ্রাম শহরে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসও পুরনো । চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে বৈশাখী উৎসব আয়োজন হয় । জব্বারের বলীখেলা এখানকার প্রধান ও অন্যতম আকর্ষণ । ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালি যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বদেশী চেতনা সৃষ্টি এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন । সেই থেকে এখনো এই বলী খেলা আয়োজন হয়ে আসছে । ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান রাজ্য থেকে বিখ্যাত বলীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন । বলীখেলার পরিবর্তে অনেকেই একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে ।

জব্বারের বলীখেলা
জব্বারের বলীখেলা

খেলাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানের চারপাশে আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দিনের মেলা বসে । কার্যত এই মেলা পাঁচ থেকে ছয় দিন পর্যন্ত থাকে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে । বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়।

(চলবে)

Similar Posts