কোমাঃ মৃত্যুর নিকট আত্নীয় সম্পর্কে কিছু খুঁটিনাটি
বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার মতো অবস্থাটাকে ডাক্তারি ভাষায় কোমা বলা হয়। একজন জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ করেই যেন নিথর
হয়ে যায়। প্রথম প্রথম মনে হয় যেন সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন অনেক সময় পেরিয়ে যায়, তবুও ব্যাক্তির জ্ঞান ফেরে না, তখন বিষয়টা পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একটা মানুষ জীবিত থেকেও মৃত, বিষয়টা সত্যি কেমন যেন।
কোমায় যাওয়া আসলে কী?
গ্রিক শব্দ “কোমা” অর্থ গভীর ঘুম। সাধারণত এই শারীরিক অসুস্থতার জন্য দীর্ঘ সময় ঘুমের সদৃশ হওয়ার কারণে একে কোমা বলা হয়। যদিও কোমা ও গভীর ঘুম এর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। এটি কেবল একটি শারীরিক অসুস্থতা।
কোমা বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একেবারেই চেতনাহীন হয়ে যাওয়া। একজন স্বাভাবিক মানুষের ভেতর যখন কোনো রকমের চেতনা কাজ করে না, সে বেঁচে আছে কি মরে গেছে এটাই বুঝতে পারে না, তখন বলা হয়ে থাকে যে সে কোমায় চলে গেছে।
কোমায় যাওয়ার প্রক্রিয়াটা ঠিক কীভাবে হয়?
আমাদের মস্তিষ্কে ঘুম এবং চেতনা অবস্থার মাঝে কিছু স্নায়বিক ব্যাপার-স্যাপার রয়েছে। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় রেটিকুলাম অ্যাক্টিভিটিং সিস্টেম বা আর এ এস। মূলত এই স্নায়বিক ব্যাপারটাই একজন মানুষের ঘুম ও জেগে থাকার যে চক্র আছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কোন কারনে চক্রটির মাঝে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় কিংবা কোষগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয় তখনই মানুষ চেতনাহীন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ কোষগুলোতে রক্ত চলাচল বাঁধাগ্রস্ত হলে তখন-ই স্ট্রোক করে মানুষ কোমায় চলে যায়।
কোমায় যাওয়া কিংবা চেতনাহীন হয়ে পড়ার কারণগুলো কী কী?
অনেক কারনেই একজন সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারে। যেমন-
১) সাধারণত বড় ধরণের কোনো দূর্ঘটনায় মাথায় প্রাপ্ত আঘাতের কারণে কোনো ব্যাক্তি কোমায় চলে যেতে পারেন।
২) কিছু ক্ষেত্রে হৃদরোগও এই কোমায় চলে যাওয়ার জন্য দায়ী।
৩) মস্তিষ্কে ইনফেকশন জনিত কারণেও স্নায়বিক কোষ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে তখনও একজন কোমায় চলে যেতে পারে।
৪) দীর্ঘ সময়ের জন্য অক্সিজেনের অভাবও মস্তিষ্ককে নষ্ট করে দিয়ে ব্যাক্তি কে কোমায় নিয়ে যেতে পারে।
৫) ওষুধ বা অন্য কোনোভাবে মাদকের অতিরিক্ত সেবন করাও কোমায় যাওয়ার কারণ।
৬) স্ট্রোক অথবা শরীরের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা একইভাবে কোমার কারণ হতে পারে।
৭) অতিরিক্ত মানসিক আঘাতের কারণেও কোন ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারেন।
কোমায় গেলে ঠিক কি রকম অনুভূতি হয়?
কোমায় থাকা ব্যাক্তি যেহেতু জীবিত এবং স্নায়ুজনিত আলাদা কোন সমস্যা নেই। তাই তিনি সবকিছুই অনুভব করতে পারেন। তার আশেপাশে কি হচ্ছে সেটা তিনি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। তাকে কেউ স্পর্শ করলেও তিনি সেটা বুঝতে পারেন। মোটকথা এই যে, কোমায় চলে যাওয়া ব্যক্তি তার আশেপাশে কি হচ্ছে সেটা টের পেলেও কোনোভাবেই বিশ্লেষণ করতে পারে না। তথা তিনি কোনো মানুষের ডাক শুনতে পারবেন ঠিক-ই, কিন্তু ডাকের প্রতি সাড়া প্রদান করতে পারবেন না।
কোমায় থাকা ব্যক্তির দেহে পুষ্টি সরবরাহ কীভাবে হয়?
কোমায় থাকা ব্যক্তি সাধারণ মানুষের মতো নড়াচড়া করতে পারে না। ফলে নিজের খাবারটাও তিনি নিজে খেতে পারেন না। এমনকি পানীয় পান করতে পারেন না। মূলত তারা তাদের ক্ষুধার কথা কিংবা পিপাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে তাদের অন্য প্রক্রিয়ায় পুষ্টি সরবরাহ করার প্রয়োজন পড়ে। শুধু পুষ্টি-ই না, অনেক কারণে তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা হয়। ফলে সে ক্ষেত্রেও আলাদা ভাবে ব্যবস্থা করতে হয়।
যখন শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা হয়, তখন ভেন্টিলেটর যন্ত্রের সাহায্যে ব্যক্তির শ্বাস প্রশ্বাস এর ব্যবস্থা করতে হয়। রোগীর শিরার মাধ্যমে তার দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি রোগীর পাকস্থলীতে নল প্রবেশ করানোর মাধ্যমে পানি সহ অন্যান্য খাবার সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি খাদ্য থাকে তরল পদার্থের।
কোমায় থাকার অভিজ্ঞতা কেমন?
কোমায় থাকার অভিজ্ঞতার বিষয়টা অনেক ইন্টারেস্টিং। আজ পর্যন্ত যে সকল ব্যক্তি কোমা থেকে বেরিয়ে এসেছে তাদের কাছে প্রায়ই প্রশ্ন করা হতো যে, কোমায় থাকাকালীন অবস্থায় আপনার কেমন লেগেছিল। তাদের উত্তর গুলোও কেমন যেন অস্বাভাবিক ছিল। কেননা তারা এমন সব কাহিনীর বর্ণনা দিতে থাকেন যেগুলো প্রকৃতপক্ষে ঘটেইনি। অনেকেই এই ব্যাপারটাকে দুঃস্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু এখানে কথা আছে। একজন কোমায় থাকা ব্যক্তি কখনোই দুঃস্বপ্ন কিংবা কোনো ধরনের স্বপ্ন দেখতে পারেন না। কেননা তার মস্তিস্ক এমন এক পর্যায়ে থাকে যে পর্যায়ে দুঃস্বপ্ন দেখা কি, কোনো ধরনের স্বপ্ন দেখাই সম্ভব না।
তবে কোমায় থাকা অবস্থায় দুঃস্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?
আসলে কোমায় থাকা রোগীরা যে বিষয়টি ব্যক্ত করেন তা মোটেই দুঃস্বপ্নের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেহেতু তাদের পক্ষে স্বপ্ন দেখা সম্ভব না। তাদের এই বিষয়টিকে নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়
এবং যে বিষয়টি বের হয়ে আসে তা হলো-
একজন কোমায় থাকা ব্যক্তি আশেপাশে কি হচ্ছে তা সর্বোচ্চ বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার স্নায়ুগুলো থাকে ক্রটিপূর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। তাই স্নায়ুগুলো অনেক কিছুই তালগোল পাকিয়ে ফেলে। তার মস্তিষ্কে ঘোরাফেরা রত অস্পৃষ্ট মেমোরি অচিরেই সৃষ্টি করে দেয় হ্যালুসিনেশনের। এই হ্যালুসিনেশনটা এতটাই রিয়েলাস্টিক হয় যে, কোমা থেকে ফিরে এসে ব্যক্তি বলেন যে তার সাথে এসব ঘটনাই ঘটেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কিছুই তার সাথে ঘটেনি।
কোমা থেকে ফিরে এসে অনেকের বাচনভঙ্গি বদলিয়ে যায় কিংবা ভাষা গুলিয়ে ফেলেন। কেননা যখন তিনি স্বাভাবিক ছিলেন তখন কোনো না কোনোভাবে তিনি অনেকগুলো ভাষা কিংবা কালচারের সাথে যুক্ত ছিলেন। অনেক কিছুই আয়ত্ত করেছিলেন। এর ফলে তার মস্তিষ্ক সবকিছু তালগোল পাকিয়ে তাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয় ফলে তারা সু স্পষ্টভাবে কোন কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। আবার অন্যভাবে বলা যায়, তাদের কথার কোন অর্থ-ই দাঁড়ায় না। বিজ্ঞানীরা এই সমস্যাটার নাম দিয়েছেন ফরেন একসেন্ট সিনড্রোম।
বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মেও তারা অনেক ভুল করে বসেন। জুতোর ফিতে বাঁধার মত কাজ তাকে পুনরায় শিখে নিতে হয়।
কোমার মেয়াদ কতদিন?
কোমায় চলে যাওয়ার পর সপ্তাহখানেকের ভেতর ব্যক্তি ঠিক হয়ে যান। কোমায় থাকার মেয়াদ কয়েক দিন থেকে কয়েক বছর হতে পারে। যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোমায় থাকার অধিকারী হলেন এডওয়ার্ড ওবারা। তিনি প্রায় ৪২ বছর কোমায় থেকে ২০১২ সালে মারা যান। আবার সম্পৃক্ত আরব আমিরাতে সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হয়ে ২৭ বছর কোমায় থাকেন মুনিরা আব্দুল্লাহ।
এই ছিল কোমা নিয়ে যাবতীয় আলোচনা। কোমার সকল খুঁটিনাটি তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি এই আর্টিকেলটিতে। আশা করি ভালো লেগেছে। আজ এ পর্যন্ত-ই। ভালো থাকবেন।