বিশ্বের বিস্ময়, আমাদের গর্ব- ঢাকাই মসলিন (১ম পর্ব)
বিশ্বের বিস্ময় ঢাকাই মসলিন হারিয়ে গেছে আরো শত বছর আগে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে যা কিছু নিয়ে গর্ববোধ করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো মসলিন কাপড়। কলকাতা, মুর্শিদাবাদ সহ অন্য আরো কিছু জায়গায় মসলিন আজও তৈরি করা হয়। কিন্তু ঢাকাই মসলিনের বিশেষত্বই ছিলো আলাদা। সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী আর নকশার জন্য ঢাকাই মসলিন সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিলো, এর সাথে অন্য স্থানের মসলিনের তুলনা করা চলে না। ঢাকার পরিবেশ, অবস্থা ও আর্দ্রতা মসলিনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী ছিলো।
ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্রের নাম হলো ‘মসুল’। এখানে খুবই সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি হতো। এর সঙ্গে মিলিয়ে ঢাকার সোনারগাঁওয়ে তৈরি হওয়া অসাধারণ বুননশৈলীসম্পন্ন সূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেওয়া হয় মসলিন। ঢাকার ইতিহাস বেশি পুরনো নয়। তবে মসলিনের ইতিহাস বহু পুরানো। একেবারে প্রথম শতকের কিছু বইয়ে মসলিন কাপড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় আগত মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা চতুর্দশ শতকে তাঁর ‘কিতাবুল রেহালা’-তে ঢাকাই মসলিনের প্রশংসা করেন। পঞ্চদশ শতকের চীনা লেখকগণ এবং মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ বিখ্যাত আবুল ফজল প্রমুখ মসলিন কাপড়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
ঢাকাই মসলিন ছিলো আভিজাত্যের প্রতীক। ভারতের মুঘল রাজপরিবার তো বটেই, সেই সাথে সুদূর চীন, আমেরিকা, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, মিশর, ইউরোপসহ গোটা বিশ্বের রাজা- রাজড়াদের কাছে মসলিন ব্যাপক সমাদৃত হয়েছিলো। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম সুতায় মসলিন তৈরি হতো বলে এটি হতো খুবই স্বচ্ছ। কথিত আছে যে- ৫০ মিটার দীর্ঘ ঢাকাই মসলিনকে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো। এক থান কাপড় একটি আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে টেনে বের করা যেতো।
বুননশৈলী ও সুতার সূক্ষ্মতা এবং মানের উপর ভিত্তি করে মসলিন কাপড়কে প্রায় ২৮ রকম ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- মলবুস খাস, সরকার-ই-আলা, খাসসা, শবনম, আর-ই-রওয়ান, ঝুনা, সর-বন্ধ, ডোরিয়া, নয়ন সুখ, বদন খাস, জামদানী ইত্যাদি। এদের মধ্যে মলবুস খাস নামক কাপড়টি হলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। এটিই আসল মসলিন। এটি মুঘল সম্রাট ও বিভিন্ন বিদেশি রাজা- রাণীদের জন্য তৈরি করা হতো। আর জামদানী হলো নিম্নমানের মসলিন। জামদানি ঢাকায় আজও উৎপাদন করা হয়। ঢাকাই জামদানি শৈল্পিক গুণে আসল মসলিনের একেবারে সমান না হলেও এটি সর্বত্র সমাদৃত।
ঢাকার আশেপাশে চাষ হতো ফুটি কার্পাস তুলা। এটির চাষাবাদে ছিলো নানা নিয়মকানুন। শরৎকালে এবং বসন্তকালে এর চারা বপন করা হতো। বসন্তের ফুটি কার্পাস ছিলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। বীজসহ কার্পাসকে বোয়াল মাছের চোয়ালের দাঁত দিয়ে আঁচড়ে তুলা থেকে অপদ্রব্য আলাদা করা হতো। মসলিন তৈরির জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হতো। ১ কি.মি. সুতাকে ওজন করলে যত গ্রাম হয়, তা দিয়ে সুতার দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে ঐ সুতার কাউন্ট পাওয়া যায়। ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সুতার ওজন যদি ৩.৩৩ গ্রাম হয়, তবে এটি প্রায় ৩০০ (বা ১০০০ ÷৩.৩৩= ৩০০.৩) কাউন্টের সুতো।
ফুটি কার্পাস থেকে এত সূক্ষ্ম সুতা তৈরি করতে ভীষণ ধৈর্য আর দক্ষতার প্রয়োজন হয়। পারিবারিকভাবে তাঁতিদের সন্তানদের হাতেখড়ি হতো এসব কাজে। তাই বড় হয়ে এরা খুবই দক্ষ হয়ে উঠতো। এত সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য বাতাসে আর্দ্রতা দরকার। তাই খুব ভোর থেকে শুরু করে সকালে রোদ উঠার আগে এবং বিকালে সূর্যাস্তের আগে এ কাজ করা হতো। আর্দ্র বাতাস পেতে নদীতে ভাসমান নৌকায় সুতা কাটা হতো বলেও অনেকে ধারণা করেন। এসব কাজে প্রখর দৃষ্টিশক্তি ও হাতের আঙ্গুলের প্রখর চেতনা শক্তির প্রয়োজন হতো। নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হতো। ৩টি আঙুলকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করে রাখতে হয়, প্রখর অনুভূতিশক্তি থাকতে হয়। যান্ত্রিক কোনো মাপ না থাকায় সম্পূর্ণ মনোযোগের মাধ্যমেই চরকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সুতা ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)