টেলিপ্রম্পটার: বিখ্যাতদের সাবলীল ও অনর্গল বক্তব্য প্রদানের লুকায়িত হাতিয়ার
আপনারা প্রায়ই টিভিতে বা অনলাইনে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের বক্তব্য দিতে দেখে থাকবেন। কখনো খেয়াল করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্ক্রিপ্ট না দেখে কিভাবে সাবলীল ও অনর্গলভাবে বক্তব্য দেন? অনেকেই হয়তো একে প্রেসিডেন্টের আশ্চর্য দক্ষতা মনে করেন। কিংবা অনেকেই মনে করতে পারেন, প্রেসিডেন্ট বুঝি বক্তব্য মুখস্ত করে এসেছেন! বাস্তবে আসলে এ দুটির কোনোটিই নয়। লিখিত স্ক্রিপ্ট দেখে বক্তব্য দেয়াটা একটু দৃষ্টিকটু দেখায়। তাই এমন সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ একটি কৌশল প্রয়োগ করা হয়, যার নাম হলো টেলিপ্রম্পটার (Teleprompter)। একে অনেকেই কেবল বুলেট প্রুফ শিল্ড ভেবে ভুল করে থাকেন।
টেলিপ্রম্পটার আসলে কী:
‘টেলি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘দূর’, ‘প্রম্পট’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘প্রণোদিত করা’। তাই ‘টেলিপ্রম্পটার’ এর আভিধানিক অর্থ হলো ‘যা দূর থেকে প্রণোদিত করে’। অর্থাৎ, যে যন্ত্র বা আইসিটি ডিভাইস এর মাধ্যমে দূর থেকেই বক্তাকে বক্তব্য দানে প্রণোদিত করা হয়, তাই টেলিপ্রম্পটার (Teleprompter)। সহজ কথায় বলতে গেলে, টেলিপ্রম্পটার একটি চমৎকার ডিজিটাল আইসিটি ডিভাইস। যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত কৌশলে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে করে এর স্ক্রিন কেবল বক্তাই দেখতে পারেন। বক্তার বিপরীত দিকে বসে থাকা দর্শকগণ কিংবা ক্যামেরায় এ স্ক্রিন দেখা যাবেনা। বক্তার সামনে স্বচ্ছ কাঁচের স্ক্রিন থাকে, যাতে ভেসে আসা লেখা কেবল বক্তাই দেখতে পাবেন। শ্রোতাগণ স্ক্রিনকে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার কাঁচের ফ্রেম হিসেবেই দেখতে পাবেন, স্ক্রিনের লেখা দেখতে পাবেন না। অনেকে হাসিচ্ছলে এটাকে স্বচ্ছ কাঁচের ‘ম্যাজিক উইন্ডো’ (Magic Window) হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের কিছু স্বাভাবিক ঘটনা।
কার্যকৌশল:
ছবিতে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল টেলিপ্রম্পটার ও এর কার্যকৌশল দেখানো হয়েছে। টেলিপ্রম্পটারের স্ট্যান্ডের নিচের দিকে একটি আইসিটি ডিভাইস/এলইডি মনিটর থাকে। যা সাধারণত ভূমির সাথে এমনভাবে ফিট করা হয়, যেন দূর থেকে বোঝা না যায়। এই মনিটরে বক্তার বক্তব্যকে ফ্লিপ করে (আয়নায় যেরকম উল্টো দেখায়) দেখানো হয়। এই মনিটর থেকে আলো বের হয়ে বক্তার সামনে থাকা কাঁচের ফ্রেমে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলিত হয়। তারপর সরাসরি বক্তার চোখে প্রবেশ করে। ফলে বক্তার মনে হয়, তিনি যেন তাঁর বক্তব্য সামনে কাঁচের ফ্রেমেই দেখতে পাচ্ছেন। এলইডি মনিটরে লেখাগুলো ফ্লিপ করে দেখানোর কারণে তা পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলিত হওয়ার পর বক্তার কাছে সাধারণ লেখার মতোই দেখা যায়।
অপরদিকে, বক্তার বিপরীত পাশে থাকা দর্শক/শ্রোতা/ক্যামেরা স্বচ্ছ কাঁচ ফ্রেমের মধ্য দিয়ে কেবল বক্তাকে দেখতে পায়। পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনে আলো প্রতিসরিত হয়না বলে দর্শক/শ্রোতা/ক্যামেরা কাঁচের ফ্রেমে কোনো লেখা দেখার পরিবর্তে স্বচ্ছ দেখতে পায়। এলইডি মনিটরে ফ্লিপ করা টেক্সটগুলো বক্তার বক্তব্যের গতি অনুযায়ী সামঞ্জস্য রেখে প্লে করা হয়। অনুষ্ঠানস্থলে বসে বক্তব্য শুনছেন এমন একজন ব্যক্তি বক্তব্যের সাথে তাল মিলিয়ে এই এলইডি মনিটর নিয়ন্ত্রণ করেন।
ইতিহাস:
ক্লাসিক থিয়েটারে বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত ‘পিপার্স গোস্ট’ (Peeper’s Ghost) ইল্যুশান থেকেই টেলিপ্রম্পটারের উদ্ভব হয় বলে ধারণা করা হয়। বার্টন, হিউবার্ট ও বের্লিন নামক ৩ বন্ধুর প্রতিষ্ঠান ‘টেলিপ্রম্পটার কর্পোরেশান’ (TelePrompter Corporation) ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই বছরই তারা পরীক্ষামূলকভাবে অ্যানালগ টেলিপ্রম্পটার তৈরি করেন। অ্যানালগ পদ্ধতি ব্যবহার করে ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টিভি উপস্থাপক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ টেলিপ্রম্পটার ব্যবহার শুরু করেন। আমেরিকাতেই ১৯৮২ সাল থেকে কম্পিউটার ভিত্তিক টেলিপ্রম্পটার ব্যবহার শুরু হয় বলে জানা যায়।
পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফনের সাহায্য নিয়ে এই টেলিপ্রম্পটারের মাধ্যমে প্রায়ই বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। এর ফলে তাঁরা একদিকে যেমন সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন, তেমনি অন্যদিকে দর্শক আকর্ষণে মনোযোগ দিতে পারেন। পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের পরিবর্তে সাধারণ প্রতিফলন এর মাধ্যমেও অনেক টেলিপ্রম্পটার প্রচলিত রয়েছে, যেগুলো সাধারণত প্রেস/নিউজরুমে বেশি ব্যবহার করা হয়। এভাবেই প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সাবলীল ও সুন্দর উপস্থাপনা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করছে।