উড়ন্ত মাছ (Flying Fish) সত্যিই কি উড়তে পারে?

উষ্ণ ও গভীর সমুদ্রের আশ্চর্জনক এক প্রাণী হচ্ছে উড়ন্ত বা উড়ুক্কু মাছ ( Flying Fish )। নাম উড়ুক্কু মাছ হলেও আসলে কিন্তু এরা উড়ে না। এরা লাফ দেয় এবং গ্লাইড করে। উড়ন্ত মাছ ( Flying Fish ) পানির ভিতর থেকে জেগে উঠে ৮-১০ মিটার উপরদিয়ে ৪০০মিটার দূরত্ব পর্যন্ত প্রায় ৪৫ সেকেন্ডের জন্য বাতাসে ভেসে থাকতে পারে । পূর্বের ভূমধ্য সাগরের নাবিকরা মনে করতেন যে এই উড়ন্ত মাছ রাতে কুলে ফেরত আসতো বিশ্রাম নেয়ার জন্য । এজন্য একদেরকে  Exocoetidae বলে ডাকতো । স্টেভ হওয়েলসের বই “ দ্যা অ্যামেইজিং ওয়ার্ল্ড অফ ফ্লাইং ফিশ” অনুসারে ল্যাটিন ভাষা  “ex” মানে কোন কিছুর বাহিরে আর  “koitos” অর্থ বিছানা ।

can-a-flying-fish-really-fly

উড়ন্ত মাছের বৈশিষ্ট্যঃ

টর্পেডো আকৃতির এই উড়ন্ত মাছ সমুদ্রে খুবই দ্রুত সাতার কাটতে পারে। এদের এই টর্পেডো আকৃতি পানিতে দ্রুত সাঁতারে সাহায্য করে । ফলে এরা যথেষ্ট গতি উঠাতে পারে যাতে করে পানির পৃষ্ঠ ভেদ করে শূন্যে অনেক্ষণ ভেসে থাকতে পারে। এদের এই গতিই শিকার হওয়া থেকে এদেরকে রক্ষা করে। ম্যাকেরেল, টুনা , সোর্ড ফিশ , মারলিন এবং বিভিন্ন বড় আঁকারের মাছ এদের প্রধান শত্রু ।

উড়ন্ত মাছ কি রকম

এদের ডানার মতো ছদ্মবেশী পাখনা শূন্যে অনেক্ষণ গ্লাইড করতে সাহায্য করে। ফলে দেখে মনে হয় এরা উড়ছে । আসলে তাদের পানিতে থাকা গতিকে কাজে লাগিয়ে বাতাসে অনেক্ষণ ভেসে থাকছে পরিবর্তিত পাখনাকে কাজে লাগিয়ে। বেঁচে থাকার জন্য উড়ন্ত মাছ প্লাংটন সহ নানা রকমের খাবার গ্রহন করে থাকে ।

৪০ প্রজাতির বেশি রকমের উড়ন্ত মাছ দেখতে পাওয়া যায় । অনেক প্রজাতির দুই পাশে দুটি দুটি করে মোট চারটি পেলভিক পাখনা থাকে । এদের টর্পেডো আকৃতির দেহের শেষের দিকে অপ্রতিসম লেজ থাকে । কাঁটা চামচের মতো দেখতে লেজের নিচের অংশ উপরের অংশ থেকে বেশি লম্বা হয়। নিচের অংশের কশেরুকা বর্ধিত হয়ে লেজকে এই রকম নৌকার হালের মতো তৈরি করেছে ।

উড়ন্ত মাছের বৈশিষ্ট্য

এদের দৈর্ঘ্য লম্বায় ৬ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। যা মোটামুটি একটি বা দুটি ইটের দৈর্ঘ্যের সমান । তরুণ মাছেরা যখন ২ ইঞ্ছির মতো লম্বা হয় তখনি তারা উড়তে শুরু করে । বায়োলজিস্ট ডেভিনপোর্টের মতে এরা ডলফিনের মতো দ্রুত গতির শিকারিদের এড়ানোর জন্য উড়ার ক্ষমতা পেয়েছে । এদের চোখের কর্নিয়া পিরামিড আকৃতির পর্দা দ্বারা বেষ্টিত। তাই এটি এদেরকে শুধু পানির ভেতরেই দেখতে সাহায্য করে না বরং এরা যখন বাতাশে গ্লাইড করে তখনো উপর থেকে পানির মধ্যে দেখতে পায়। ফলে তাদের শিকারকে সহজেই নজরে রাখতে পারে।

উড়ন্ত মাছ আসলে উড়তে পারে না

উড়ন্ত মাছ এতোই গতিতে পানিতে সাঁতার কাটে যে এরা যখন পানি থেকে লাফ দেয় তখন উড়ছে না গ্লাইড করছে তা খালি চোখে বুঝা যায় না । পূর্বে বায়োলজিস্টরা নিশ্চিত ছিলেন না যে আসলে তারা তাদের পাখনাকে পাখির মতো কাজে লাগিয়ে উড়ছে কিনা। তারপর ১৯৪১ সালের দিকে যখন হাই স্পীড ক্যামেরা ব্যাবহার করা হয় তখন বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে তারা আসলে উড়ছে না । তারা তাদের পাখনা কে কাজে লাগিয়ে দ্রুত গতিতে গ্লাইড করছে। পানি থেকে লাফ দেয়ার পূর্বে তারা যথেষ্ট গতি অর্জন করে বাতাশে ভেসে থাকার জন্য ।

উড়ন্ত মাছ আসলে উড়তে পারে না

লাফ দেয়ার পূর্বে উড়ন্ত মাছ পানিতে প্রতি সেকেন্ডে ৬ ফুট গতি অর্জন করতে পারে যা আসলে তাদের দৈর্ঘ্যের ২০ থেকে ৩০ গুন লম্বা। এসময় তাদের পাখনা গুলোকে শরীরে সাথে শক্ত করে লাগিয়ে রাখে । এবং পানি থেকে লাফ দেয়ার পর পাখনা মেলে দেয়। পাখির মতো পাখনাকে ব্যাবহার না করে তারা তাদের গতিকে কাজে লাগিয়ে গ্লাইড করে । সবচেয়ে দীর্ঘ লাফ গিনিজ বুকে লেখা হয়েছে ৪৫ সেকেন্ড এবং গতি ছিল প্রায় ৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করার রেকর্ড করা হয়েছে ৪০০ মিটারের মতো । উড়ন্ত মাছ সর্বোচ্চ ৮ মিটার বা ২৬ ফুট পর্যন্ত পানির উপরে উঠতে পারে এবং অনেকগুলো পরপর গ্লাইড করে ।

গ্লাইড শেষে পানিতে নেমে এরা খুবই দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করে এবং পরবর্তী গ্লাইডিং এর জন্য পর্যাপ্ত গতি লাভ করে। এভাবে এরা পরপর সর্বোচ্চ ১২ টি গ্লাইড করতে পারে। ডেভেনপোর্ট ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ধারনা করেছেন যে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় উড়ন্ত মাছ সাধারণত লাফ দেয়া না । কারন এর থেকে কম তাপমাত্রা পেশীকে কাজ করতে বাঁধা দেয়। তাই এদেরকে সাধারণত উষ্ণ পানিতে দেখতে পাওয়া যায়।

যেভাবে উড়ন্ত মাছ শিকার করা হয়

উড়ন্ত মাছ আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় । ফলে জেলেরা সহজেই এদেরকে আলোর লোভ দেখিয়ে ধরতে পারেন। রাতের বেলায় আলোকিত সংরক্ষিত পানিতে আলোর লোভ দেখিয়ে এদেরকে শিকার করা হয়। তবে সম্প্রতি উড়ন্ত মাছের কিছু কিছু প্রজাতি হুমকির মুখে পড়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংএর কারনে উড়ন্ত মাছের মাইগ্রেশনের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হচ্ছে। “লাইফ অফ পাই” মুভিতে হয়তো অনেকেই এই উড়ন্ত মাছকে উড়তে দেখেছেন। এই অসাধারন, অপূর্ব, অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারি মাছটিকে আমাদের উচিত এই সুন্দর পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে না দেয়া ।

তথ্যসূত্রঃ

https://www.nationalgeographic.com/animals/fish/group/flying-fish/

https://www.livescience.com/flying-fish.html

চিত্রঃ সংগ্রহীত

Similar Posts