ধর্ম চর্চায় মূলত মূল্যবোধের চর্চা
প্রাণী এবং মানুষ এ সবই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। প্রাণীকূল থেকে মানবজাতির বিভাজন মূলত তার বুদ্ধিমত্তা, বিবেক এবং মূল্যবোধের কারণে। একজন মানুষ তখনই একজন প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারে যখন তার মাঝে মানবিক গুনাবলি গুলো স্পষ্টভাবে বিরাজমান থাকে।
মূল্যবোধ এবং ধর্মের সম্পর্ক যদি আমরা দেখতে চাই তাহলে দুইটি বিষয়কে আলাদা করে দেখার সুযোগ নাই। যেখানে ধর্মের ভিত্তি বিশ্বাস থেকে শুরু সেখানে মূল্যবোধ বিশ্বাস থেকেই গড়ে ওঠে।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের পারস্পারিক সম্পর্ক
মূল্যবোধ টা আসলে কি? মূল্যবোধ আসলে একধরনের স্থায়ী বিশ্বাস। এটি দ্বারা সাধারণত মানুষের আচরণ কে বিচার করা হয়। এক কথায় এটি মানুষের আচার-আচরণের মাপকাঠি। একজন ব্যক্তি তার জীবন কোন আদর্শে গড়ে তুলবে সেটি তার মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে।
মূল্যবোধের প্রধান সোপান হলো বিশ্বাস। আর ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। অর্থাৎ ধর্ম এমং মূল্যবোধ একটি অপরটির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
আমাদের সমাজব্যবস্থার মাঝে ধর্মের ভিন্নতা রয়েছে এবং প্রত্যেক ধর্মের মাঝেই আছে তাদের নিজস্ব নীতিমালা এবং জীবনবিধি। তবে প্রত্যেক ধর্মেই মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে প্রধান শিক্ষা হিসাবে প্রাধান্য দিয়েছে সবসময়। পৃথিবীতে যত ধর্ম বিরাজমান আছে প্রত্যেক ধর্মের প্রধান শর্ত তার সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস এবং এই সৃষ্টিকুলের কল্যাণে প্রণীত নির্দেশনা মেনে চলা। সেই ধর্মের নির্দেশনা অনুযায়ী সেই সমাজের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। এইখানেই দেখা যায় সকল ধর্মের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের ভিত্তি প্রস্তর একই পিলারে গড়ে উঠছে।
আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন চিন্তা করবো – আমাদের দেশে প্রধান চারটি ধর্মের বিচরণ রয়েছে। প্রধান প্রধান ধর্ম গুলো হলো ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধ। এইছাড়াও মানুষের প্রয়োজনে কিংবা বিশ্বাসের দিক থেকে অনেক ধর্মের প্রচলন দেখা যায়।যেমন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের তাদের নিজস্ব বিশ্বাসের উপর তাদের নিজেদের ধর্ম রয়েছে। এইখানেও তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে। তবে এমন সকল ধর্মের মূল পাঠ্য বিষয় গুলোর মাঝে প্রাধান্য দেওয়া হয় নৈতিকতার শিক্ষার উপর।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ম শিক্ষার জন্য যে সকল পাঠ্যবই প্রদান করা হয় এবং শিশুদের জন্য তৈরি নীতি নৈতিকতার শিক্ষার জন্য যে কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়, সেটি স্ব স্ব ধর্মের ধর্মগ্রন্থের আলোকে তৈরি করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ধর্মের অনুশাসন অনুযায়ী মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মানবিকতার শিক্ষা লাভ করে। তাদের শিখন পদ্ধতি ভিন্ন এবং পাঠ্য বই ভিন্ন কিন্তু তাদের শিখনফল একই। তা হলো- ‘ শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা’।
এখান থেকেই আমরা বুঝতে পারি মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষাটা আমরা আমাদের ধর্মের মাধ্যমেই শুরু করছি।
একটি সমাজ ব্যবস্থা কিভাবে চলবে সে নিয়মকানুন যেমন একটি রাষ্ট নির্ধারণ করে দেয় ঠিক তেমনি মানুষের জীবনধারা কিভাবে পরিচালিত হবে তা তার ধর্মের জীবনবিধির মাঝেই সংযুক্ত করে দেওয়া আছে।
আমাদের পৃথিবীতে যেসকল ধর্ম প্রচলিত আছে সব ধর্মেরই মূল মন্ত্র বলে দেয় কোন জীবনধারা মানুষের জন্য কল্যাণের এবং কোন বিষয়টি অকল্যাণকর। ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদের ভালো এবং খারাপের ভেদাভেদ বুঝতে শেখায়। যার মাঝে নৈতিকতা নেই , মানবিক মূল্যবোধ নেই, সে কখনো ধার্মিক হতে পারে না। কারন সকল ধর্মের মাঝে তিনটি ভিত্তি প্রস্তর রয়েছে সত্যতা, সততা এবং পবিত্রতা। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই মূল্যবোধ তৈরি হয় এবং সেই অনুযায়ী সেই সমাজের আচার ব্যবহার ও সংস্কৃতি গড়ে উঠে।
ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ
অনেক সময় আমরা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যাপারটার মাঝে তালগোল পাকিয়ে ফেলি। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি কখনোই এক নয় বরং এই দুইটার মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল তফাৎ। ধর্মীয় গোঁড়ামি বলতে আমরা সাধারণত কুসংস্কার কে বোঝাই যা এই আধুনিক সমাজে হয়তো একদমই অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদের জীবন বা রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থায় সবসময়ই সমাদৃত।
কোন ধর্মই সন্ত্রাস ,খুন, গুম, অরাজকতা শেখায় না এমনকি প্রশ্রয়ও দেয়না। ধর্মীয় মুল্যবোধ মানুষকে শান্তির পথে চলতে শেখায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানবিকতার অভাব হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। প্রায়ই মানুষের অমানবিক এবং পাষন্ড আচরণ আমাদের চোখে পড়ে। ধর্মীয় মূল্যবোধ শুরু থেকেই একজন মানুষের মাঝে মানবিকতার বিকাশ ঘটায়। ধর্ম আমাদের ভিন্ন হতেই পারে। আমরা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হতেই পারি। কিন্তু মানবিকতার চর্চায় সব ধর্মই আমাদের উৎসাহ দেয়।
বিভিন্ন ধর্মে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা
যদি আমাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের পথ প্রদর্শকদের জীবনধারা এবং তাদের দিক নির্দেশনার দিকে দৃষ্টি দেই । তাহলে দেখতে পাই,
ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী ও রাসুল মুহাম্মদ (স) মানব জাতিকে সত্যের পথে আহবান করেছেন। তিনি মানবতার প্রতীক হিসাবে মুসলিম জাতির পথ প্রদর্শক । তিনি সকলের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানুষ হিসাবে যে সকল গুণাবলি অর্জন করা উচিত সে বিষয়ে মানুষদের দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। মানুষের হৃদয়ের মাঝে মানবিকতা, সঠিক বিবেক, ও ন্যায় নীতিবোধ বিবেচনা করে সত্যের পথে জীবনযাপন করার জন্য মানব জাতিকে উৎসাহিত করেছেন। ইসলাম ধর্মের প্রত্যেক আসমানী কিতাবের সাথে মানবিক মূল্যবোধকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে।
হিন্দু ধর্মালম্বীদের পথপর্দশকগণও যুগে যুগে সৃষ্টির প্রতি দয়ার কথা বলেছেন। কিভাবে মানুষের মাঝে মানবিক গুনাবলি ও মূল্যবোধের জাগরণ ঘটানো সম্ভব তেমনি নীতিকথার গল্পের প্রচলন রয়েছে হিন্দু ধর্মের মাঝে।
খ্রিষ্টান ধর্মের দিকে নীতিকথা যখন আমরা দেখবো, তাদের ধর্মের মূল নীতির মাঝে প্রথম স্থানে আছে মানবিক মূল্যবোধ ও মানবিক গুনাবলি। যেখানে স্রষ্টার সৃষ্টি সকল কিছুর প্রতি ভালোবাসা ও মানবিকতা দেখানোর জন্য বলা হয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল পাঁচটি নীতিকে বলা হয়ে থাকে মানব নীতি । কারন এখানে মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলা হয়।
এমন করে পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধর্মের মাঝে মানবিকতা, মানবিক যে সকল গুনাবলি মানুষকে একজন নীতিবান ও বিবেকবান মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে সে দিকটি গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
মূলত সকল ধর্মের মূল কথা একটি, ‘ ‘তোমার স্রষ্টা রয়েছেন এবং তুমি দায়বদ্ধ, তোমার হিসাব দিতে হবে তাঁর কাছে। কাজেই তুমি ভালো পথে চলো। মন্দ কাজ করো না।’
অর্থাৎ যেখানে ধর্মে বিশ্বাস গড়ে উঠবে সেখানেই মূল্যবোধ গড়ে উঠবে। এবং পৃথিবীর সকল ধর্মে একই মূল্যবোধের কথা বলে যা মানুষের জন্য মঙ্গলজনক।
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের গুরুত্ব
মূল্যবোধ আসলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। নৈতিকতা,আদর্শ এবং মূল্যবোধ এই তিনটি জিনিসের কখনোই কোনো বিকল্প নেই। এই ৩ টি জিনিস একজন মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। যেসব মানুষ চরম বিপদের সময়েও এই তিনটি জিনিস থেকে বিচ্যুত হয়না তাদেরকে আমরা আদর্শ মানুষ হিসেবে বিবেচিত করি। যদিও বর্তমান সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম তাই দিন দিন সামাজিক অবক্ষয় বেড়েই চলেছে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাদের সুষ্ঠু জীবন পরিচালনার জন্য পথপ্রদর্শক। ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া সমাজে যেমন বিশৃখলা সৃষ্টি হবে তেমনি সমাজের নীতিমালার শিকল ছিঁড়ে যাবে। তাই সুস্থ ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।