আপনি কি প্রফেশনাল?
“প্রফেশনালিজম” কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিন্তু যদি আমরা একজন শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থী তরুণ-তরুণীর কথা বলি তাহলে প্রফেশনালিজম হলো আমরা কোন প্রফেশনাল ক্ষেত্রে নিজেকে কতটা তৈরি হিসেবে উপস্থাপন করি এবং সর্বোপরি নিজ নিজ কর্মক্ষত্রে যোগ দিতে আমরা কতটা পারদর্শী। এক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম হলো আপনি একজন প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিকভাবে কতটা যোগ্য কোন কাজের জন্য। একজন প্রাথমিক সারির প্রফেশনাল মানুষ হয়ে উঠতে গেলে আপনাকে কিছু রসদ তৈরি করতে হবে যাতে আপনি এগিয়ে থাকতে পারেন প্রতিযোগিতায়। আজকে সেরকম কিছু রসদ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করলাম।
১. নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা
প্রথমেই আসে আপনার নিজের সম্পর্কে ধারণার কথা। আপনি নিজের জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং সেগুলো পূরণ করতে আপনার সামর্থ্য, দুর্বলতা, সুযোগ-সুবিধা ও আনুসঙ্গিক বাধা-বিপত্তি সম্পর্কে জানেন কিনা। আপনি নিজেকে কোন কোন ক্ষেত্রে যোগ্য মনে করেন ও কোন কোন বিষয়ে দুর্বল ভাবেন। এগুলো জানতে হলে আপনাকে নিজের জীবণের vision, mission ও objectives ঠিক করে নিতে হবে এবং personal SWOT analysis (Strength, weakness, opportunity, threats) করতে হবে।
Personal SWOT analysis এর কথা অনেকেই শুনেছেন বা না শুনে থাকলে এখন জানুন। এখানে Strength এবং weakness হলো আপনার অন্তর্গত শক্তি এবং দুর্বলতা বা দিকগুলো অপরদিকে opportunity ও threats হলো বহির্গত সুযোগ ও বাধাসমূহ। এই strength, weakness, opportunity, threats যদি আপনি বের করতে পারেন তবে আপনার লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য আপনার আশংকা ও দ্বিধাগুলো কেটে যাবে। আপনি হাতে লিখে বা কম্পিউটারে ওয়ার্ড ফাইল তৈরি করে খুব সহজেই তৈরি করে নিতে পারেন একটি Personal Analysis Document। আর কীভাবে তৈরি করবেন সে তথ্য দেয়ার জন্য ইন্টারনেট তো আছেই। আপনি শুধু Personal SWOT/ Personal vision, mission and objectives লিখে খুঁজে দেখুন, অসংখ্য তথ্য পাবেন এই সম্পর্কিত। আর এটি তৈরি করতে পারা মানেই বোঝায় আপনি নিজেকে জানেন, নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন আপনার জীবণের লক্ষ্য অর্জনে। আপনার কর্মক্ষেত্র বেছে নেয়া ও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে এটি দারুণ সাহায্য করবে।
২. প্রফেশনাল Curriculum Vitae বা CV
এরপর আসে আপনার একটি প্রফেশনাল Curriculum Vitae বা CV। হ্যাঁ, আপনাকে একটি প্রফেশনাল ও স্মার্ট CV এর অধিকারী হতে হবে। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে এটা থাকাটা অবশ্যই উচিত যা আপনার কর্মক্ষত্রে আপনাকে উপস্থাপন করবে। CV এর মাধ্যমেই কোন চাকরির আবেদনে আপনি নিজেকে, নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতাগুলোকে তুলে ধরতে পারবেন।
একটি প্রফেশনাল CV তৈরি করা খুব কঠিন কিছু নয়। আপনার মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের হাতেখড়ি থাকলেই সুন্দর ও তথ্যসম্বলিত CV তৈরি করতে পারবেন। এজন্য আপনার কিছু বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং বিষয়গুলোকে নথিভুক্ত করতে হবে। যেমনঃ আপনার কোন ক্ষেত্রে কাজ করার ইচ্ছা আছে,আপনার কর্মক্ষেত্রে আপনি কি অবদান রাখতে পারেন, কর্মক্ষেত্রে আপনার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য দায়িত্ব, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, পিতা-মাতার নাম, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, বৈবাহিক অবস্থা, স্বামী-স্ত্রীর নাম), আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আপনার দক্ষতার ক্ষেত্রগুলো, আপনার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমগুলো, আপনি কোন কোন বিষয়ে পারদর্শী, আপনার অর্জন ও অভিজ্ঞতা, আপনার শখের ও ভালোলাগার দিকগুলো ইত্যাদি। এগুলো নথিভুক্ত হয়ে গেলে আপনার দরকার হবে একটি প্রফেশনাল CV ফরম্যাট এর। আর ইন্টারনেটে Professional CV format লিখে খোঁজ করলে অসংখ্য CV ফরম্যাট পাবেন। এরপর আপনার কর্মক্ষেত্র অনুসারে নির্দিষ্ট একটি ফরম্যট বাছাই করুন আর আপনার তথ্যগুলো সাজিয়ে নিন ওই ফরম্যাটে। প্রথম চেষ্টাতেই যে খুব ভালো হবে তা নয়। আপনি ধীরে ধীরে আপনার CV টিতে আরো সংযোজন ও পরিবর্তন করতে পারেন।
৩. প্রফেশনাল ইমেইল
ইমেইল কে প্রফেশনাল যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয় পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাতে। কমবেশি সবাই আমরা ইমেইল ব্যবহার করে থাকি আর কারো যদি না থাকে তাহলে একটি ইমেইল আইডি অবশ্যই তৈরি করে নেবেন mail.google.com থেকে। প্রফেশনাল ইমেইল পাঠানোর জন্য সঠিক ইমেইল অ্যাড্রেস, সিগনেচার এসব বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ইমেইল এড্রেস এর তিনটা ভাগ থাকে। আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস যদি হয় karimchowdhury1 @gmail.com এখানে karimchowdhury হলো user name, @ হলো sign, gmail.com হলো domain। এখানে দেখার বিষয় হলো ইউজার নেম। আর user name টি সঠিকভাবে দেয়ার মধ্যেও নির্ভর করে কো্ন প্রফেশনার ক্ষেত্রে ইমেইল পাঠালে আপনার ইমেইলটি বিবেচনা করা হবে কিনা। user name দেয়ার সময় নিজের নাম দেয়ার চেষ্টা করুন। আপনার নামে যদি অন্য আইডি আগে থেকেই থাকে তাহলে নামের পর সংখ্যা যোগ করে অথবা নামের upper case, lower case পরিবর্তন করে আপনি user name সেট করতে পারেন।
এবার আসি সিগনেচার এর কথায়। আপনার ইমেইল সিগনেচার আপনার পরিচয় বহন করে যাদেরকে আপনি ইমেইল পাঠাচ্ছেন তাদের কাছে। আপনি যদি ইমেইল এ সিগনেচার সেট করে রাখেন তাহলে প্রতিবার ইমেইল পাঠানোর সময় আপনাকে নতুন করে পরিচয় লিখতে হবেনা। ইমেইল সিগনেচার সেট করার জন্য ইমেইল এ লগ ইন করার পর উপরে ডান কোণায় (@gmail.com এর ক্ষেত্রে) একটি সেটিংস বাটন দেখতে পাবেন। সেখানে ক্লিক করে সেটিংস অপশনে গিয়ে আপনি সিগনেচার যুক্ত করতে পারেন। সিগনেচার এ আপনি আপনার নাম, সৌজন্যমূলক কথা বা ধন্যবাদ, আপনার ডিগ্রি, কর্মক্ষেত্রে আপনার পদবী, যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওয়েবসাইট লিংক ইত্যাদি যোগ করতে পারেন। ইমেইল সম্পর্কে আরো বিস্তারিত পরের একটি আর্টিকেলে লেখার চেষ্টা করবো।
৪.একটি পারসোনাল ওয়েবসাইট বা ব্লগ
একটি পারসোনাল ওয়েবসাইট বা ব্লগ আমাদের ব্যাক্তিত্ত্বকে প্রফেশনাল জায়গায় তুলে ধরে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে আপনার একটি পারসোনার ওয়েবসাইট থাকা মানে বোঝায় আপনি যথেষ্ট আপডেটেড। আর পারসোনাল ব্লগ বা ওয়েবসাইট আপনি বিনামূল্যেই তৈরি করতে পারেন সহজেই। https://sites.google.com/ এ আপনি আপনার ফ্রি ওয়েবসাইট ও https://wordpress.com/create-blog/ এ গিয়ে আপনি আপনার ব্লগ শুরু করতে পারেন। ওয়েবসাইট টিকে আপনি নিজের পোর্টফোলিও হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন যেখানে আপনার বৃত্তান্ত থাকবে আর ব্লগে লিখতে পারেন আপনার পছন্দের বিষয় নিয়ে। মনে রাখবেন, কোন বিষয়ে লেখালেখির দক্ষতা অধিকাংশ জায়গাতেই সমাদৃত।
৫. বেসিক সফটওয়্যার স্কীল
আমরা সবাই আইটি বা কম্পিঊটার সাইন্স এ পড়াশোনা না করলেও কিছু কিছু টেকনিক্যাল বিষয় ও সফটওয়্যার এ একজন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীর দক্ষতা অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রেই চেয়ে থাকে। সেগুলো হলো MS Word, MS PowerPoint, MS Excel, Adobe Photoshop and Illustrator। আপনাকে পুরোদমে এক্সপার্ট হতে হবে এমনটা কিন্তু নয়, আপনার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজ করার জন্য যতটু্কু দক্ষতা প্রয়োজন ততটুকু শিখে নিতে পারলেই যথেষ্ট। আর এগুলো শিখতে আপনাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল আর যদি সার্টিফিকেট কোর্স করতে চান তবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে করতে পারেন কম খরচেই।
৬. গুরুত্বপূর্ণ নথি-পত্র সঠিকভাবে সংরক্ষিত রাখা
আপনার যত গুরুত্বপূর্ণ নথি আছে যেমনঃ জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট, সনদপত্র ও অন্যান্য দরকারী কাগজপত্রগুলোর ফটোকপি ও স্ক্যান কপি করে রাখবেন। ফটোকপি বা স্ক্যান কপি রাখতে না পারলেও অন্তত ছবি তুলে রেখে দিবেন। নিজের একটি পাসপোর্ট ও স্ট্যাম্প সাইজের ছবির কপি মোবাইল, কম্পিউটার বা পেন-ড্রাইভে সেভ করে রাখবেন সবসময় যাতে জরুরী প্রয়োজনে সেখান থেকে ছাপিয়ে নিতে পারেন। আর এসব তথ্য নিরাপদে রাখতে পারেন Cloud storage এ। আপনার যদি একটি ইমেইল একাউন্ট থাকে তবে আপনি https://www.google.com/drive/ এ তথ্যগুলো বিনামূল্যে সংরক্ষণ করতে পারেন। তাও যদি না পারেন তবে আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বস্ত কারো ইনবক্সে বা আপনার অন্য একটি আইডিতে তথ্যগুলো মেসেজ আকারে পাঠিয়ে রাখতে পারেন। এভাবে রাখলে আপনি গুরুত্বপূর্ণ নথি ও কাগজপত্র হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে উদ্ধার করতে পারবেন এবং জরুরী প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহার করতে পারবেন।
আজ এই পর্যন্ত থাকলো। আপনি যদি এখানে বর্ণিত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারেন তবে আপনি নিজেকে একজন শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থী হিসেবে প্রাথমিক সারির প্রফেশনাল বলতে পারেন। চেষ্টা করেই দেখুন কতটা কাজে দেবে এই বিষয়গুলো আপনার জীবন ও কর্মক্ষেত্রে।