পৃথিবীর ১০ টি দুর্গম স্থান যেখানে মানুষের পা পড়েনি
আমাদের এই পৃথিবী অপার বৈচিত্রময়। এই পৃথিবীতে যেমন রয়েছে বিচিত্র পরিবেশ , ধ্যান – ধারনা , বিশ্বাস , বিচিত্র মানুষ তেমনি এমন সব বৈচিত্র্যময় স্থানও যেখানে হয়তো মানুষের পা পড়েনি এখনো । আমাদের এই জানা পৃথিবীতে অজানাদের কমতি নাই । পৃথিবীর এই বৈচিত্র্য , অজানাদের হাতছানি সব সময় আমাদেরকে বিস্মিত করেছে। সবসময় দূর থেকে ডেকে মনে জন্ম দিয়েছে কৌতূহল । কিন্তু মানুষের এই কৌতূহল মেটানো অত সহজ নয় , রয়েছে বিপদের আশঙ্কা । চরম পরিবেশ, দুর্ভেদ্য জঙ্গল , প্রকৃতির নানা খেয়ালে হয়তো পৌঁছানো হয় নি অনেক জায়গায়ই । এমনি ১০ টি আশ্চর্যজনক স্থান সাথে আজ আমরা পরিচিত হবো যেখানে মানুষের এখনো পৌঁছানো হয় নি ।
সাইবেরিয়ান সাখা রিপাবলিক
চিত্রঃ সাইবেরিয়ান সাখা রিপাবলিক Source: Wikipedia
পৃথিবীর দুর্গম স্থান এর মধ্যে রয়েছে সাইবেরিয়ান সাখা রিপাবলিক (ইয়াকুটিয়া নামেও পরিচিত)। এটি রাশিয়ার ২০ শতাংশ জায়গা জুড়ে অবস্থিত । এর বেশিরভাগ অঞ্চল আর্কটিক সার্কেলের (সুমেরু অঞ্চল) উপরে অবস্থিত । এখানে মানুষের থাকার জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ নেই কারন এই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রী ফারেনহাইটের ( মজার ব্যাপার হল সেলসিয়াস স্কেলেও এই তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ) কাছাকাছি । প্রায় ভারতের সমান আয়তনের এই সাইবেরিয়ান সাখা রিপাবলিক তার চরম অবহাওয়ার জন্য বেশিরভাগ অঞ্চল মানুষের দ্বারা অনুসন্ধান করা হয় নি । এই অঞ্চলের মাটিকে সাধারণ মাটি বলে ডাকা হয় না । প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অবহাওয়ার জন্য এর মাটিও জমে শক্ত হয়ে যায় যাকে পারমাফ্রস্ট বলে ডাকা হয় । এখানে শুধু যে বরফই জমে থাকে তাই নয় মাটিও জমে থাকে ।
চিত্রঃ বরফ জমা সাখা
ভেল ডো জাভারি
চিত্রঃ লাল চিহ্নটি Vale Do Javari . Source: Google Map
পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম স্থান এর মধ্যে রয়েছে ভেল ডো জাভারি । ব্রাজিলে এবং পেরুর সীমানায় অবস্থিত জাভারি নদীর নাম অনুসরে এর নাম রাখা হয় । ব্রাজিলে অবস্থিত এই অঞ্চলটি অস্ট্রিয়ার থেকেও বড় । এই অঞ্চলে কোন আধুনিক মানুষের পা পড়েনি আজ পর্যন্ত । আসলে আমাদের পৃথিবীতে এমন লোকবসতি খুব কম যারা আধুনিক আলো কখনো দেখেনি । এদের মধ্যে ১৪ টি গ্রুপই এই ভেল ডো জাভারিতে দেখা যায় । এইসব বনে থাকা মানুষের গ্রুপ এখনো সেই আদিম মানুষের মতো করে জীবন যাপন করছে । আধুনিক পৃথিবী থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন । ভেল ডো জাভারি তে তিন হাজারের মতো আদিম মানুষ সনাক্ত হয়েছে। তারা নাকি কখনই গাড়ি তো দূরে থাক চাকাই দেখেনি । ব্রাজিল সরকার এই জায়গায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং তাদের উপর হেলিকাপ্টারের মাধ্যমে ঢিলেঢালা নজর রাখা হচ্ছে । এই মানুষগুলো যেভাবে আদিম মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতো ঠিক সেভাবে জীবনযাপন করছে । ন্যাশনাল ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন, এই এরিয়া কে সবচেয়ে বেশী আদিম মানুষ বসবাসকারী স্থান বলে ঘোষণা দিয়েছে।
চিত্রঃ আমাজনের আদিম মানুষ ; Source: Wikimedia
মারিয়ানা ট্রেঞ্চঃ
চিত্রঃ মারিয়ান ট্রেঞ্চ
মারিয়ানা ট্রেঞ্চ দুর্গম স্থান গুলোর মধ্যে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে । মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরতম স্থান যার ব্যাস প্রায় ১৫০০ মাইল লম্বা । এটি ফিলিপাইনের পূর্বে পেসিফিক মহাসাগরে অবস্থিত । সর্বচ্চো গভীর স্থানটি চ্যালেঞ্জের ডীপ নামে পরিচিত যার গভীরতা ১০,৯৯৪ মিটার । যদি মাউন্ট এভারেস্ট এই গভীরতায় ঢুবিয়ে দেয়া হয় তুবুও এক মাইল গভীরে এর চূড়া ডুবে থাকবে । এই গভীরতায় মানুষ পৌঁছালে বিপুল পরিমান পানির চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যেতো । জেনোফায়োফোরই একমাত্র প্রাণী যা এই গভীরে টিকে থাকতে পারে । জেনোফায়োফোর এক ধরনের অদ্ভুত একক অর্গানীজম ( একক কোষীয় লাফই ফর্ম) যা পানির মিনারেল ব্যবহার করে চাপ সামলাতে এক্সোসকেলেটন ( বহিরকঙ্কাল ) তৈরি করে বেঁচে থাকে । কিছু কিছু বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এখানে সামুদ্রিক দানবের ( বিশাল আঁকারের হাঙ্গর ) অস্তিত্ব রয়েছে ।
গাংখর পেনসুমঃ
চিত্রঃ গাংখর পেনসুম
দুর্গম স্থান গুলোর মধ্যে পাহাড় থাকবে না তা কি হয় ? গাংখর পেনসুম হলো এইরকমই একটি চুড়া । গাংখর পেনসুম ( Gangkhar Puensum) এর অর্থ হল তিন আধ্যাত্মিক ভাইয়ের সাদা চুড়া । এটি ভুটানে অবস্থিত সবচেয়ে উঁচু পাহাড় যেটিতে এখনো কেউ আরোহণ করতে পারে নি । এই পাহাড় উচ্চতার দিক থেকে বিশ্বে ৪০ তম স্থানে অবস্থান করছে । চারটি আলাদা টিম ১৯৮৫ এবং ১৯৮৬ সালে এই পাহাড়ে উঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু চরম আবহাওয়ার জন্য তারা ব্যার্থ হন । ১৯৯৪ সালের পর থেকে এলাকার বাসিন্দাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে ওই এলাকায় ৬০০০ মিটাররে বেশী উচ্চতায় উঠা নিষিদ্ধ করা হয় । এবং সবশেষে পাহাড়ে আরোহণ করা মানুষের সংখ্যা কমে আসলে ২০০৩ সালে সব ধরনের পাহাড়ে আরোহণ বন্ধ করে দেয়া হয় । তাই কেউ যদি এই পাহাড়ে আরোহণ করতে চায় তাকে সর্বপ্রথম ভুটান সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে । এজন্যই এই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা কখনো সম্ভব হয় নি ।
স্টার মাউন্টেনস
চিত্রঃ স্যাটেলাইট থেকে তোলা স্টার মাউন্টেনস ; Source: Wikipedia
দুর্গম স্থান গুলোর মধ্যে পাপুয়া নিউ গিনি অন্যতম । পাপুয়া নিউ গিনির পশ্চিমে দূরবর্তী অঞ্চলে স্টার মাউন্টেনস অবস্থিত । স্টার মাউন্টেনস অনেকগুলো পাহাড়ের সমষ্টি যা ইন্দোনেশিয়া বর্ডার থেকে শুরু করে হিনডেনবার্গ দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত । হিনডেনবার্গ ওয়াল হল চুনাপাথরের তৈরি মাইল খানেক উঁচু মালভূমি । এখানে বেশিরভাগ অঞ্চল মানুষের দ্বারা অনুসন্ধান করে দেখা হয় নি । মানুষের পা পড়েনি বিধায় এখানে অনেক প্রজাতির অনন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছে । প্রায় এক হাজার একশো প্রজাতি এখানে শনাক্ত হয়েছে যার ১০০ টি পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানে খুজে পাওয়া যায় না । স্টার মাউনটেন তার ভিজে আবহাওয়ার জন্য খ্যাত । বছরে এখানে প্রায় ১০,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঘটে ।
ইউকাটান সেনোটঃ
চিত্রঃ ইউকাটান সেনোট ; Source: Gallery Stock
ইউকাটান সেনোট হল ম্যাক্সিকোতে অবস্থিত অনেকগুলো গুহার নেটওয়ার্ক । সেনোট তখনি তৈরি হয় যখন চুনাপাথরের সাথে বেডরকের সংঘর্ষ হয় । গুহা হল প্রকৃতির এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ পা ফেলতে সহজে সাহস করে না । খুব কম সংখ্যক গুহাই মানুষের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু ইউকাটান সেনোট হলো এমন একটি গুহা যেটি সম্পূর্ণ পানিতে ডুবে রয়েছে । যেটা এই গুহায় বিচরণ আরও কঠিন করে তুলেছে। এমনকি সামুদ্রিক মাছেরাও এই গুহা এরিয়ে চলে । প্রাচীন মায়ান সভ্যতা নাকি এইরকম গুহায় মানুষ বলিদানে ব্যবহার করতো এবং ইউকাটান সেনোট এই লিস্ট থেকে বাদ যায় নি ।
সিংসি দে বামারাহ জাতীয় উদ্যানঃ
চিত্রঃ সিংসি দে বামারাহ
মাদাগাস্কারে দুর্গম স্থান এর মধ্যে রয়েছে সিংসি দে বামারাহ । এটি পশ্চিম মাদাগাস্কারে অবস্থিত । মাদাগাস্কার অনেক দূরবর্তী দুর্গম এলাকায় হওয়ায় ইউরোপিয়ানের কাছে এটি প্রথমে অনাবিষ্কৃত ছিলো । সিংসি দে বামারাহ অর্থ হল যেখানে কেউ খালিপায়ে হাটতে পারে না । কাঁটার মতো দাড়িয়ে থাকা এইসব ছোট পাহাড় মানুষের চলাচলের একেবারে অযোগ্য । দেখেই মনে হয় হাটতে গেলে পায়ে কাঁটা ফুটে যাবে । বিচরনের জন্য এই স্থানটি খুবই দুর্গম যার জন্য বেশিরভাগ জায়গায় মানুষের কোনো সময়ই পা পড়েনি ।
দুর্গম স্থান গ্রিনল্যান্ডঃ
চিত্রঃ গ্রীনল্যান্ড ; Source: Google Map
নাম সবুজের স্থল হলেও সবুজ খুঁজতে গেলে কিন্তু বিপদে পড়ে যাবেন । কারন এর পুরোটাই থাকে সারা বছর বরফে ঢাকা । সাদা চাদরে ঢাকা এই দেশটিই এই প্ল্যানেটের সবচেয়ে বড় দ্বীপ । ৮০ শতাংশই পুরো দেশটির বরফে ঢাকা । আট মিলিয়ন স্কয়ার মাইলের এই দেশটিতে মাত্র ৫৬ হাজার মানুষের বাস । মানে দাঁড়ায় এর বেশির ভাগ অঞ্চল চরম আবহাওয়ার জন্য বসবাসের অযোগ্য এবং মানুষের দ্বারা ঘুরে দেখা হয় নি । প্রতিবছর বরফের পর বরফ জমা হতে হতে বিশাল আঁকারের বরফের স্তূপ সৃষ্টি হয় । এই বরফের স্তূপ গুলো কোন কোনটি ৪ লক্ষ্য থেকে ৮ লক্ষ্য বছরের পুরনো এবং তিন হাজার দুইশো মিটারেরও বেশী উঁচু হয় ।
নামি মরুভুমিঃ
নামি মরুভুমি পৃথিবীর সবচেয়ে অনুর্বর মরুভুমির মধ্যে একটি । এখানে বছরে গড়ে মাত্র ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় বলে এটি পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম স্থান । এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মরুভূমি হিসেবে বিশ্বাস করা হয় । ৩১০০০ স্কয়ার মাইলের পুরো স্থানটি ই বসবাসের একেবারে অযোগ্য । তবে কিছু স্থানীয় উপজাতি পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে এখানে বসবাস করে । এই মরুভূমি নামিবিয়ার একটি বিরাট অংশ দখল করে রেখেছে । এখানে পানি নেই বললেই চলে । সাথে কিছু অভিযোজিত প্রাণী আর মরুভূমির গাছই এখানে বেঁচে থাকতে পারে ।
উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপঃ
চিত্রঃ বঙ্গোপসাগরে আবস্থিত সেন্টিনেল দ্বীপ
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো সেন্টিনেল দ্বীপটি আমাদের বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত । এই দ্বীপটিতে কিছু মানবগোষ্ঠী বাস করে যারা বাহিরের মানুষের আগমনকে ভাল চোখে দেখে না । ভেল ডো জাভারির মানুষের মতোই এরাও আধুনিক সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন । এই দ্বীপটি ভারত সরকারের আওতাভুক্ত । ভারত সরকার এই মানবগোষ্ঠীকে আলাদা করে নিজেদের মতো করে থাকতে দিচ্ছে । বাইরের মানুষ এখানে খুব কমই পা ফেলেন । সম্প্রতি ২০০৬ সালে দুই জেলে তাদের নৌকা নিয়ে এই দ্বীপে ভুলবশত চলে যায় । এবং ফলাফলস্বরূপ তারা দুজনই দ্বীপের উপজাতিদের আক্রমনে নিহত হয় ।
চিত্রঃ সেন্টিনেল দ্বীপের উপজাতি
তথ্যসূত্রঃ
https://blitzlift.com/the-most-unexplored-places-on-earth/
https://historydaily.org/the-little-known-history-of-north-sentinel-island-untouched-by-modern-civilization