লেক মিশিগান তীরের শিকাগো শহর ( ১ম পর্ব )

শিকাগোর কথা মনে গেঁথে যায় সেই ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে হে মার্কেটের আন্দোলন নিয়ে লেখাটা পড়ে। শ্রমিকদের আট ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে সেই ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ার উত্তাল হয়ে উঠে। গোলাগুলি, হতাহত, বিচার, প্রহসন, রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো অনেক কিছু হয়। ইতিহাসে সেটা “হে মার্কেট এফেয়ার” নামে পরিচিত। সেখানে থেকেই জন্ম নেয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। তারপরে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। আমার জানা নেই, এখনো সেই হে মার্কেট আন্দোলনের কথা ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত আছে কি না।

travel-to-chicago

আমাদের জন্য শিকাগো শহরের দুরত্ব অনেক বেশি। আমরা থাকি আলাবামা অঙ্গরাজ্যে, আর সেখানে থেকে সড়কপথে শিকাগোর দুরত্ব প্রায় ১১ ঘন্টার। কিন্তু এই মহামারীর সময়ে বিমানযাত্রার চিন্তা বাদ দেয়াই ভালো মনে হল। সাহস করে গাড়ি নিয়েই এতটা পথ চলে গেছি।

শিকাগো আমেরিকার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বড় শহর। সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি, শিকাগো বাতাসের শহর, আকাশছোঁয়া ভবনের শহর। সত্যিই ভবনগুলো এতটাই উঁচু যে মাঝে মাঝে তাদের ওপরের অংশ মেঘে ঢেকে যায়। কিছু কিছু ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে পুরোপুরি ক্যামেরার ফ্রেমেও ধরা যায় না! এই আকাশচুম্বি উচ্চতার মাঝেও কিছু ভবনে বাহারি নকশার ছোঁয়া রয়েছে, যা সেগুলোতে আলাদা সৌন্দর্য যোগ করেছে। আর লেক মিশিগান থেকে আসা বাতাস শিকাগো শহরের যেকোন প্রান্তে থেকে অনুভব করা যায়। এখনো পর্যন্ত শিকাগো শহরের উচ্চতম ভবন হচ্ছে উইলিস টাওয়ার যেটা আগে সিয়ারস টাওয়ার নামে পরিচিত ছিল। এর নকশাকার ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার, ফজলুর রহমান খান। উইলিস টাওয়ার প্রায় ২৫ বছর ধরে পৃথিবীর উচ্চতম ভবনের স্থান দখল করে ছিল। তারপরে তার চেয়েও উচ্চ ভবন তৈরি হতে থাকায় সেটা তালিকায় ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে। পৃথিবীতে আসলে আকাশচুম্বি ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা থেমে নেই, এখনো চলছেই।

 

মিলেনিয়াম পার্ক
মিলেনিয়াম পার্ক

 

তবে শিকাগো শহরটা কিন্তু সবসময় এমন ছিল না। এতো এতো আকাশছোঁয়া ভবনও সেখানে ছিল না। শিল্পায়নের শহর হিসেবে প্রথম থেকেই আমেরিকায় আসা অভিবাসীদের মাঝে শিকাগো বেশ জনপ্রিয় ছিল। এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকাসহ আরো অনেক দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা তাদের আমেরিকান স্বপ্ন মনে নিয়ে এই শহরে বসতি গড়ে তুলতে থাকে। লেক মিশিগানের পাশে অবস্থানের জন্য শিকাগো সবসময়েই বাড়তি সুবিধা পেয়ে এসেছে। লেক মিশিগান প্রায় সমুদ্র সমান বিশাল এক লেক। বিভিন্ন ছোট বড় খাল, নদীপথ হয়ে সেটা সমুদ্রের সাথেও যুক্ত। জলপথে পণ্য পরিবহণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে সেটায় খরচ কম। আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে পণ্য আসত। তাই শিকাগো খুব দ্রুত শিল্পায়নের শহরে পরিণত হয়। প্রচুর সংখ্যক অভিবাসীদের আশ্রয় এবং চাকরি জোটে এই শহরে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থান সংকুলান হয় ঘনসন্নিবিষ্টভাবে তৈরি করা কাঠের দালানে। শিকাগোর নিকটবর্তী বনভূমিগুলোতে ওক গাছের অভাব ছিল না। সেগুলোই মানুষ দালানকোঠা তৈরিতে ব্যবহার করত। কাঠের ভবন তৈরিতে খরচ এতো কম যে মানুষ সেটার বাইরে অন্য কিছু চিন্তাও করতে পারত না। ফলে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, সরকারি ভবন সবকিছুই ছিল কাঠের তৈরি। আজকের যে জাঁকজমকপূর্ণ শিকাগো শহর, তার সাথে সেই কাঠের শহরের অনেক পার্থক্য।

শিকাগোবাসীর মনে কিন্তু ভয় ছিল যে তাদের এই শহরে কখনো আগুন লেগে গেলে তা মুহুর্তেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। শিকাগোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও যথেষ্ট ভালো ছিল, এমনকি সেইসময় আমেরিকার মধ্যে সেটা উন্নততম ছিল। তারপরেও শিকাগোবাসীর সব ভয়কে সত্যি করে ১৮৭১ সালের এক শরতের রাতে শহরে আগুন লেগে যায়। খুব অল্প সময়ে সেটা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন বাতাসের বেগও ছিল বেশি, সেই বাতাস আগুনকে আরো ছড়িয়ে দেয়।

(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)

ডাউনটাউন শিকাগো

Similar Posts