টর্নেডোর গল্প

আমি আপাতত আমেরিকায় সপরিবারে আছি। করোনাকালীন লকডাউনের মাঝে যখন টর্নেডো এসে সবকিছু আরো দুর্বিষহ করে দিয়েছিল, এটা সেসময়ের গল্প।

সময়টা এপ্রিল মাস। আমাদের শহরে তখন স্টে হোম অর্ডার চলছে। আশেপাশে কাউকে তেমন দেখা যায় না। ইউনিভার্সিটির ক্লাস অনলাইনে চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই বাড়ি চলে গিয়েছে। রাস্তায় গাড়িও খুবই কম। মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি টহল দিয়ে যায়। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য কেনা এবং মাঝেমধ্যে বাসার আশেপাশে হাঁটাহাঁটি ছাড়া আমরাও কোথাও বের হইনা। চারিদিকে থমথমে একটা অবস্থা। এরই মাঝে টর্নেডোর আগমন। খবরে সতর্কতা জানানো হয় যে টর্নেডো শহরের ওপরে দিয়ে যাবে এবং ওয়ার্নিং দিলে সকলে যেন দ্রুততম সময়ে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যায়।

ঘটনার দিন সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হল। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ একটা ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সাথে মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারও রাখলাম। করোনা আর টর্নেডোর মধ্যে টর্নেডোকে গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক বলে মনে হল কারণ সেটা এই মুহূর্তে ঘাড়ের ওপর ফোঁসফোঁস শুরু করে দিয়েছে। কিন্ত সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলেও মাঝারি বৃষ্টি ছাড়া আবহাওয়া তেমন খারাপ হয়নি। তাই সাহস করে জানালার পাশে বসে পড়লাম ঝড় দেখার আশায়।

বাংলাদেশে থাকতে ঝড় উঠলেই দরজা জানালা সব বন্ধ করে লোডশেডিং এর অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকতাম। কখনো খুব কাছে থেকে ঝড় দেখা হয়নি। বৃষ্টির সাথে হালকা ঝোড়ো হাওয়া আর বিদ্যুৎ চমক ছিল। এমন কিছুক্ষণ চলার পরে হঠাৎ সবকিছু কেমন ভয়ংকর হয়ে গেল। বাতাসের বেগ হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেল। প্রচণ্ড বাতাসের তোড়ে বাসার দু’পাশের গাছের ডাল জানালার ওপর এত জোরে আছড়ে পড়তে লাগল যে মনে হচ্ছিল এক্ষুণি জানালার কাচ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ এর শিখা বেশ কয়েকবার মাটি পর্যন্ত নেমে এল। শোনার ক্ষমতা ভোঁতা করে দেয়া বাজের শব্দের সাথে যুক্ত হয়েছিল দুই মোবাইলে বিকট শব্দে বাজতে থাকা টর্নেডো এলার্ট- বেজেই যাচ্ছে, “টেক শেল্টার নাউ”। এতো বৃষ্টি, এই অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব না। কিন্তু বাসার নিরাপদ স্থানে বসে কোনভাবেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তীব্র বাতাসের শব্দে মনে হচ্ছিল ছাদ শুধু নয়, পুরো বাড়িই উড়ে চলে যাবে। এমন ভয় খুব কমই পেয়েছি।

বৃষ্টির বেগ একটু কমতে গাড়ি নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে রওনা হলাম। সেসময় আমাদের প্রতিবেশীদের অনেককেই যেতে দেখলাম। গাছের ডাল পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আমাদের অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হল। সেই দুর্যোগের রাতে প্রচুর গাড়ি লাইন দিয়ে শেল্টারে যাচ্ছিল, তাই পৌঁছাতে কিছুটা সময় লেগেছিল। এখানে প্রতিটি এলাকার অধিবাসীদের জন্য শেল্টার নির্দিষ্ট করে দেয়াা থাকে। আমাদের বাসা ইউনিভার্সিটির কাছে হওয়ায় নিকটবর্তী শেল্টারটা ছিল ইউনিভার্সিটির ভেতরে নীচতলার বড় একটি ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখলাম ভয়ে আর তাড়াহুড়োয় শুধু পানির বোতল সাথে আনতে পেরেছি; টর্চ, মাস্ক, স্যানিটাইজারসুদ্ধ ব্যাগটা বাসায় থেকে গেছে।

তবে অবাক হয়েছিলাম আমেরিকানদের দেখে। কম্বল, চাদর, বালিশ, ল্যাপটপ, চার্জার, বই, কফি কতকিছু নিয়ে মানুষ এসেছে কারণ আশ্রয়কেন্দ্রে কতক্ষণ থাকতে হবে তার ঠিক নেই আর এসময় তাপমাত্রাও হঠাৎই নেমে যায়। সৌভাগ্যবশত আধাঘন্টা পর টর্নেডো ওয়ার্নিং ক্যানসেল করে দেয়া হয়। বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে হল যে দেশে বছরে গড়ে এক হাজারটা টর্নেডো আঘাত হেনে থাকে তাদের দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি পোক্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক। আর শেখা গেলো পরবর্তীতে আশ্রয়কেন্দ্রে দৌড় দেওয়ার সময় সাথে আরো কি কি নিতে হবে।

 

Similar Posts