পূর্ব বাংলার আকাশজয়ী “জিনেট ভান তাসেল”
“যদি পাখির মত উড়তে পারতাম “! এ কথাটি আমরা সকলে ভুল করে হলেও একবারের জন্য ভেবেছি ৷ সাল ১৮৯০, আমেরিকা -ইউরোপ তখন মেতে আছে ঢাউশ সাইজের গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে মানুষের আকাশে ভেসে বেড়ানোর আমেজে। কিন্তু, ভারতীয় উপমহাদেশে তখন মানুষের আকাশে ভাসার ঘটনা অনেকটা রাজকুমারের পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় উড়ে যাওয়ার গল্পের মত ছিল। তবে, ১৮৯২ সালের ১৬ মার্চ সব কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সত্যি ঢাকার আকাশে এক রাজকুমারীকে বেলুনে ভর করে উড়তে দেখা যায়। সে ভিনদেশী রাজকুমারীর নাম হচ্ছে “জিনেট ভান তাসেল”।
আমেরিকার সিনসিনাটির ওহাইওতে স্থপতি পিতার ঘরে জিনেটের জন্ম৷। তিনি ছিলেন প্রেসবাইটেরিয়ান খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। পরবর্তীতে, তারই মত অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পার্ক এ ভান তাসেলের সঙ্গে তিনি প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ভান তাসেলের পারিবারিক ব্যবসা ছিল বেলুন প্রদর্শনী। প্রথম নারী হিসেবে জিনেট ১৮৮৮ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসে বেলুন ভর করে প্রায় এক মাইল উঁচুতে উঠে আকাশ জয় করেন৷ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে নবাব খাজা আহসানুল্লাহ কলকাতায় গিয়ে ভান তাসেল দম্পতির সাথে ঢাকায় এসে বেলুনে উড্ডয়নের জন্য চুক্তি করেন৷ উড্ডয়নের দিন ধার্য্য করা হয় ১০ মার্চ ১৮৯২। নবাব পুরো শহরজুড়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এই বেলুনে ভর করে উড়ার কথা প্রচার করেন৷
নবাবের বাড়ির মহিলারা যাতে এই প্রদর্শনী দেখা থেকে বঞ্চিত না হয় তাই আহসান মঞ্জিলের ছাদ জিনেটের অবতরণের জন্য নির্ধারিত করা হয়৷ কিন্তু, নির্ধারিত দিনটিতে দক্ষিণ দিকে বাতাসের প্রবল বেগ ছিল যা বেলুন উড্ডয়নের জন্য মোটেও অনুকূল ছিলনা। বেলুন প্রদর্শনী কোম্পানির অনিচ্ছাসত্ত্বেও নাছোড়বান্দা নবাব অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে নির্ধারিত দিনেই জিনেটকে বেলুন করে উড্ডয়নের জন্য রাজী করান৷
নির্ধারিত দিনে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, নৌকায়, নদী সংলগ্ন দালানগুলোতে উৎসক জনতার ভীড় বাড়তে থাকে৷ সিলেটের খ্যাতিমান গীত-রচয়িতা হাছন রাজার ছেলে গণিউর রাজাও ছিলেন সে ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি তার ঢাকা ভ্রমণ কাহিনীতে জিনেটের বেলুনে ভর করে উড্ডয়নের কথা উল্লেখ করেছেন। তার বর্ণনানুসারে, জিনেট যে বেলুন করে
উড্ডয়ন করেছিল সেটি ছিল হট এয়ার বেলুন। বেলুনটি ফোলানোর জন্য প্রথমে লাকড়ি জ্বালিয়ে বেলুনে ধোঁয়া প্রবেশ করা হয়েছিল, তারপর ধোঁয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বেলুনটি বিশাল আকৃতিতে রূপ নেয়।
বেলুনের দড়ি যখন কেটে দেওয়া হয় তখন বন্ধুকের গুলির মত বিকট এক শব্দ হয় আর পুরো বুড়িগঙ্গা কম্পিত হতে থাকে উৎসুক জনতার করতালির শব্দে। সকলের চোখে বিষ্ময় জাগিয়ে জিনেট ভেসে বেড়াচ্ছিল আকাশে। কিন্তু, বৈরী আবহাওয়ার কারণে বেলুন প্রবল বেগে উত্তরের দিকে ভেসে যাচ্ছিল৷ নবাব বাড়ির ছাদে অবতরণের কথা থাকলেও তা আর কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। আহসান মঞ্জিল থেকে আরো দুই-তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটি ঝাউ গাছের সাথে জিনেট বেলুন সমেত ঝুলতে থাকে। সেটি ছিল নবাব পরিবারের জঙ্গলময় বাগানের একটি অংশ।
এক ইংরেজ পুলিশ অফিসার, ক’জন স্থানীয় পুলিশ কনস্টেবল ও উদ্ধারকারী দলকে সাথে নিয়ে শুরু হয় জিনেটকে উদ্ধার প্রক্রিয়া। তিনি এতটাই ভীত হয়েছিলেন যে তার মা আর ভাই আসার আগ পর্যন্ত জিনেট কিছুতেই নামতে রাজী হচ্ছিলেন না৷ অবশেষে সকলের প্রচেষ্টায় জিনেট বাঁশ ধরে নামতে শুরু করে৷ কিন্তু, নামার মাঝপথে তিনি বাঁশ ভেঙে মাটিতে পড়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। হাসপাতাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়৷
ভিনদেশী রাজকুমারীকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল নারিন্দার বিখ্যাত খ্রিষ্টান গোরস্থানে। তবে, তার শেষকৃত্যে নবাব উপস্থিত ছিলেননা। হয়তো তিনি জিনেটের মৃত্যু ঘিরে সৃষ্টি হওয়া বিতর্ক থেকে নিজেকে আড়ালে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। গবেষক শামীম আমিনুর রহমান ২০০০ সালে জিনেটের নানা ছিন্ন কাহিনী একত্রিত করে ‘ঢাকার প্রথম আকাশচারী: ভানতাসেল’ বইটি প্রকাশের মাধ্যমে আবার এই আকাশজয়ী নারীর স্মৃতি সকলের সামনে নিয়ে আসেন৷ নির্মাতা, প্রত্নতাত্ত্বি্ পর্যটক ও গবেষক এলিজা বিনতে এলাহী ১২৮ বছর পর বাংলার প্রথম আকাশচারীকে নিয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ট্র্যাভেল চলচ্চিত্র ‘ইন সার্চ অব জিনেট ভান তাসেল’ নির্মাণ করেন যেটি ২০২০ সালের ৮ মার্চ ঢাকাস্থ মাইডাস সেন্টারে প্রথম প্রদর্শিত হয়।