শীতে ত্বকের যত্নে মধু – রুক্ষ ত্বকের যত্ন নিন খুব সহজে
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ত্বকেও কিছুটা পরিবর্তন আসে শীতে। গরমে ত্বকে যে রকম সমস্যা, শীতের সমস্যা অনেকটা ভিন্ন। ত্বকের ধরন যদি শুষ্ক হয় তাহলে সব ঋতুতেই প্রধান সমস্যা থাকে শুষ্কতা। সারা বছরই যাদের ত্বক শুষ্ক থাকে শীতের সময় তাদের সমস্যা বেড়ে যায় কয়েকগুণে। শীতে ত্বকের যত্নে মধু এর ব্যবহার, অনেক ভালো একটি উপায় ত্বকের হারানো লাবণ্য ফিরিয়ে আনতে।
মধু খুব ভালো একটি Humectant হিসেবে কাজ করে:
Humectant হলো এমন একটি উপাদান যা ত্বকের সজীবতা ধরে রাখতে বিভিন্ন প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। এটি ত্বকের কোষ গুলোকে সজিব রাখে। ত্বক যখন প্রয়োজনীয় পানি হারায় তখন তা শুষ্ক ও নির্জিব হয়ে পড়ে। শীতে ত্বকের যত্নে মধু ব্যবহার করলে তা প্রাকৃতিক ভাবে আমাদের ত্বকের সজিবতাকে সিল করে দেয় যাতে, ত্বক তার সজীবতা না হারায়
ত্বকের নানা ধরনের সমস্যায় মধু
একজিমা, সোরিয়াসিস হলে আমাদের চামড়া অনেক বেশি শুস্ক হয়ে পড়ে। এ ধরনের সমস্যায় সারা বিশ্বে মধু ব্যবহার করা হয়। আয়ুর্বেদিক ঔষধে মধু ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় – যেমন পোড়া, কাটা, যে কোন ধরনের ক্ষত এবং প্রদাহ, লাল হয়ে যাওয়া ত্বক।
স্ক্রাবার এবং ময়েশ্চারাইজার হিসেবে মধুর ব্যবহারঃ
শুষ্ক ত্বকে তেলগ্রন্থি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম থাকে। ফলে ত্বক অল্পতেই শুষ্ক হয়ে যায়। আর শীত এলে এ ধরনের ত্বকে শুষ্কতা বেশি দেখা দেয়। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে। ত্বকের উপর মৃত কোষের স্তর জমে গেলে আপনি উপরে যতই লোশন, ক্রিম, প্যাক লাগান না কেন আপনার ত্বক পর্যন্ত তা পৌঁছাতে পারেনা। তাই সপ্তাহে দু-তিন দিন নিয়ম করে স্ক্রার্বিং করতে হবে।
শুষ্ক ত্বকে ক্রিম সমৃদ্ধ ক্লিনজার ব্যবহার করা উচিত। বেসন খুব ভালো ক্লিনজার হিসেবে কাজ করে। সাবানের পরিবর্তে বেসন দিয়ে দিনে দু-তিনবার পরিষ্কার ত্বক করুন। যতবার মুখ ধোবেন ততবারই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। রাতে কিছুটা হালকা ময়েশ্চারাইজিং করতে পারেন। মধু খুব ভালো কাজ করবে এক্ষেত্রে। এতে রয়েছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ভাইরাল উপাদান। নিয়মিত মধু ব্যবহার করলে ত্বক হয় উজ্জ্বল ও সুন্দর। এছাড়া ব্রণ, বলিরেখা ও রোদে পোড়া দাগ দূর করতে পারে এ প্রাকৃতিক উপাদান।
শুষ্কতা থেকে রক্ষা পেতে বেসনের সঙ্গে কাঁচা দুধ ও মধু মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে মুখে এবং দেহের অনাবৃত অংশে ব্যবহার করতে পারেন। নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক পরিষ্কার, উজ্জ্বল ও মোলায়েম হবে। স্ক্রার্বিংয়ের সময় এই মিশ্রণের সঙ্গে এক চা-চামচ চিনি মিলিয়ে নিন। এরপর পুরো মুখে লাগিয়ে পাঁচ মিনিট হালকা হাতে ম্যাসাজ করুন। তারপর উষ্ণ পানির ঝাপটা দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।এর সঙ্গে কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি পেস্ট করে মিশিয়ে নিতে পারেন।
শীতে ত্বকের যত্নে মধু দিয়ে কিভাবে বানাবেন ময়েশ্চারাইজারঃ
একটি বাটিতে একটি ডিমের কুসুমের সঙ্গে বেশ খানিকটা দুধের সর, একটু মসুর ডাল বাটা ও একটু মধু মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে ত্বকে লাগাতে পারেন। সপ্তাহে তিন দিন এ প্যাক ব্যবহারে ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্ক ভাব কমে আসবে। শুকিয়ে গেলে ঘষে ঘষে তুলে নিন। তাহলে ত্বক একেবারে ঝকঝকে হয়ে উঠবে।
এ ছাড়া পাকা পেঁপে ও মধু মিলিয়ে মুখে লাগিয়ে নিতে পারেন। পাঁচ মিনিট রাখে ধুয়ে ফেলুন। পাকা পেঁপে এবং মধু ‘ন্যাচারাল ময়েশ্চারাইজার’ হিসেবে ভালো কাজ করে।
এত উপকরণ হাতের কাছে না থাকলে ১ চা চামচ মধু সরাসরি মুখে লাগান। ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন ত্বক। প্রতিদিন ২ বার লাগালে ত্বকে আসবে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা।
ফেসিয়াল ক্লিনজার হিসেবে মধুঃ
মুখের মেকাপ রিমুভার অথবা মেকাপ গলিয়ে ফেলতে মধু খুব ভালো কাজ করে। যদি এর সাথে জোজোবা তেল অথবা নারকেল তেল মিশিয়ে নেন তাহলে আরোও ভালো কাজ করবে। মধু এবং তেল মিশিয়ে নিন একটি বাটিতে। ঘন একটা মিশ্রণ হবে। আপনার মুখে ভালো ভাবে ঘষে লাগান। এরপর হাল্কা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
মধু, হলুদ এবং গ্লিসারিন ফেস প্যাকঃ
যা যা লাগবেঃ
- ১ টেবিল চামচ অর্গানিক মধু
- আধা চা আমচ হলুদ গুঁড়া অথবা কাঁচা হলুদ বাটা
- আধা চা চামচ গ্লিসারিন
প্রনালীঃ
- সব উপকরণ একটি বাটিতে মিশিয়ে নিন।
- গলা এবং মুখে এই পেস্টটি লাগিয়ে নিন।
- এরপর শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
ক্লিওপেট্রার মধু এবং দুধের গোসল:
১/৪ কাপ মধু , ২ কাপ দুধ এবং কয়েল ফোঁটা এসেন্সিয়াল অয়েল গোসলের হাল্কা গরম পানিতে মিলিয়ে নিন। এরপর বাথটাবে রিলাক্স হয়ে শুয়ে থাকুন। যাদুকরী উপকার দেখতে পাবেন ত্বকে অল্প কয়দিনেই। এসেনশিয়াল অয়েল হিসেবে জেসমিন অথবা স্যন্ডালউড ব্যবহার করতে পারেন।
লোক মুখে শোনা যায় ক্লিওপেট্রা ৭০০টি গাধার দুধ ব্যবহার করতেন গোসল করার জন্য। মধু এবং দুধের এই কম্বিনেশন আপনাকে সজিব এবং প্রাণবন্ত করবে তুলবে।
মধু ও মিল্ক ক্রিম/দুধ
এক টেবিল চামচ মধুর সঙ্গে এক চা চামচ মিল্ক ক্রিম একসঙ্গে মিশিয়ে ১৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন। এরপর হালকা গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বক উজ্জ্বল করার পাশাপাশি ত্বকের বলিরেখা দূর করে।
দুধের সর বা মালাই নিজেই একটি প্রাকৃতিক ‘ময়েশ্চারাইজিং ক্রীম’ ।ত্বককে নমনীয় এবং কোমল করতে খুবই কার্যকর দুধের মালাই।পাশাপাশি মধু হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক এন্টি-ব্যাক্টেরিয়া। ত্বকে মধুর ব্যবহার করলে ব্রণ উঠবে না। কারণ ব্রণের হওয়ার জন্য যেসব ব্যাক্টেরিয়া দায়ী তা নষ্ট করবে মধু।
মধু ও দুধের প্যাক তৈরি করতে একটি বাটিতে ১ টেবিল চামচ দুধের মালাই এবং মধুর নিয়ে ভাল করে মিশান।মিশ্রণটিকে আপনার ত্বক ও চেহারার ওপর মেখে ১৫ মিনিট রেখে হালকা গরম পানি ধুয়ে ফেলুন।তারপর ভাল করে পানি মুছে ফেলুন। তাতক্ষণিকভাবেই আপনার ত্বকে উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করতে পারবেন। প্রতিদিন এটি নিয়মিত করুন।
গাজর ও মধু
গাজর ও মধুর মিশ্রণ ত্বকের মৃত কোষকে সরিয়ে সজীব কোষগুলোকে জাগিয়ে তোলে। এছাড়া কুচকানো ত্বকের যত্নেও কার্যকর এ মিশ্রণ।গাজরের বিটা-ক্যারোটিন এ কাজে সাহায্য করে।একটি আস্ত গাজর নিয়ে তার সাথে এক টেবিল চামচ মধু মিশিয়ে নিন। তারপর এটিকে ভাল করে চটকে মিশ্রণ তৈরি করুন।মুখে ১৫মিনিট মিশ্রণটি রেখে ধুয়ে ফেলুন।
মধু ও ডিম
ত্বকের বলিরেখা দূর করার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী এ ফেসপ্যাকটি। একটি ডিমের সঙ্গে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগান। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। ত্বক টানটান করতেও সাহায্য করবে এটি।
দই ও মধু
দই ও মধু একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করুন ফেসপ্যাক। হাত-পা ও মুখের ত্বকে লাগান। শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত করলে কোমল হবে ত্বক। এটি তৈলাক্ত ত্বকের জন্য বেশ কার্যকর। এ ছাড়া ত্বকের ব্রণ দূর করতেও এই প্যাক ব্যবহার করতে পারেন। দই বা দুধে উপস্থিত ল্যাকটিক অ্যাসিডের প্রভাবে ঝলমলিয়ে উঠবে আপনার ত্বক। শীতে ত্বকের যত্নে মধু এর সাথে দই এর এই প্যাক আপনাকে সজিব করতে পারে নিমিষেই।
মধু ও লেবুর রস
এক চা চামচ মধুর সঙ্গে এক চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে ২০ মিনিট মুখ ম্যাসাজ করুন। এরপর ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন, আপনার ত্বক এক নিমিষেই উজ্জ্বল হয়ে যাবে।
মধু, গোলাপজল ও হলুদের গুঁড়ো
এক টেবির চামচ মধু, কয়েক ফোঁটা গোলাপজল ও সামান্য হলুদের গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগান। ১৫ মিনিট পর মুখ ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বককে এক নিমিষেই উজ্জ্বল করবে।
মধু ও কলার প্যাক
শীতে ত্বকের যত্নে মধু ব্যবহার হিসেবে এক টেবিল চামচ মধুর সঙ্গে সামান্য কলা চটকে নিয়ে প্যাক তৈরি করুন। ২০ মিনিট ম্যাসাজ করুন। এরপর হালকা গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এটি ত্বকের কালচে ভাব দূর করে।
কলায় প্রচুর হাইড্রো-কার্বন থাকায় তা আপনার ত্বককে ভেজা ভেজা রাখবে। তবে আপনার ত্বক যদি তৈলাক্ত হয় তাহলে এর সাথে গোলাপ জল ব্যবহার করতে পারেন।
এছাড়াও কলা ত্বকের মৃত কোষ সরিয়ে ফেলে নিচের জীবিত কোষকে উপরে তুলে আনে। এতে আপনার ত্বক আরও সজীব লাগে।
শীতে ত্বকের যত্নে -যা করবেন না:
১। অতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন না, তাতে ত্বকের আর্দ্রতা ক্রমশ হারাতে থাকে এবং ত্বক শুস্ক হয়ে যায়।
২। গোসলের আগে অয়েল মাসাজ করলেও সোসলের পর অতি অবশ্যই যে কোন ময়েশ্চরাইজ়ার ব্যবহার করুন৷ তা না হলে শুষ্ক ত্বকের সমস্যা কোনওদিন কমবে না৷ ত্বক অল্প ভিজে থাকা অবস্থাতেই ময়েশ্চরাইজ়ার লাগিয়ে নিন৷
৩। খুব কড়া সাবান ত্বকের শুষ্কতা কেড়ে নেয় তাই হালকা কোনও সাবান বা সোপ ফ্রি ক্লেনজ়ার ব্যবহার করুন৷ বেসন, মুসুর ডাল বাটা, চালের গুঁড়ো ইত্যাদি দিয়ে ত্বক খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায়৷
৪। অ্যালকোহল আছে এমন টোনার বা যে কোনও স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট এড়িয়ে চলুন৷ মিনারেল অয়েল, কৃত্রিম রং বা সুগন্ধিযুক্ত প্রডাক্ট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন৷
৫। অহেতুক রোদ লাগাবেন না ত্বকে, বিশেষ করে সকাল নয়টার পর৷ শীতকালে সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন সব সময়৷ ছাতা, টুপি, সানগ্লাসও রোদের হাত থেকে আপনাকে বাঁচাবে৷ লিপ বাম কেনার সময়েও এমন কিছু নিন যার মধ্যে এসপিএফ আছে এবং আপনাকে আলট্রা ভায়োলেট রে থেকে রক্ষা করবে।
৬। খাদ্যতালিকায়৷ ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন সি, আর ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, আখরোট, ফ্ল্যাক্সসিড বা তিসি, ফল, শাকসবজি রাখুন৷
৭। রাতে শোবার সময় ত্বকে অলিভ অয়েল, গ্লিসারিন বা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগাবেন। নারকেল তেলও ব্যবহার করা যেতে পারে এক্ষেত্রে।
৮। ঘর হালকা গরম রাখার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে রুম হিটার অথবা হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন।
৯। শীতের আলস্যে গোসল করা থেকে বিরত থাকবেন না, কারণ তাতে লোমকূপে ময়লা জমে ত্বকে কালো ছোপ ছোপ দাগ হতে পারে এবং হতে পারে বিভিন্ন অসুখও।
১০। অপরিষ্কার ঠোঁটে লিপবাম বা লিপগ্লস লাগাবেন না।
১১। ত্বকের সমস্যা খুব বেশি মনে হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শীতে ত্বকের যত্নে মধু কে আপনি বেছে নিতে পারেন নিশ্চিন্তে। এটি প্রাকৃতিক ভাবে আপনাকে সুফল দিবে ।