পিয়েরে ট্রুডো: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান ছিল অনস্বীকার্য

সাল ১৯৭১। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন মেতে উঠেছিল রক্তের নেশায়। আর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের লড়াইটা ছিল জীবন বাঁচানোর, পৃথিবীর মানচিত্রে “বাংলাদেশ ” নামের একটি দেশ হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার। সে সময় আমেরিকার মত অনেক শক্তিশালী দেশের পূর্ণ সমর্থন ছিল পাকিস্তানের প্রতি৷ আবার আমেরিকার সাথে কানাডার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাই আমেরিকাকে খুশি রাখতে হলেও কানাডা পাকিস্তানকে সমর্থন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি। বলছি কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পিতা জোসেফ ফিলিপ পিয়েরে ইভস ইলিয়ট ট্রুডোর কথা।


তিনি ছিলেন কানাডার ১৫ তম প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক থাকার পরেও পিয়েরে ইভস ইলিয়ট ট্রুডো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি৷ তিনি সর্বপ্রথম একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। জর্জেস লুচেন্স, হিথ ম্যাকেরী ও এন্ড্রু ব্রুয়েন- এই তিন সংসদ সদস্য সে প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীরা ঠিক কোন অবস্থায় আছে সেটি সরেজমিনে দেখায় ছিল এই প্রতিনিধি দলের মূল উদ্দেশ্য।

কানাডায় ফিরে যাওয়ার পর সে প্রতিনিধি দল ১৯ জুলাই রাজধানী অটোয়ায় একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করে। সে বিবৃতি অনুসারে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরনার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৪ থেকে ৬৮ লক্ষ। তাছাড়া, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের কথাও সে বিবৃতিতে স্থান পায়৷ এই প্রতিনিধি দলটি কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিল তিনি যেন ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরনার্থীদের জন্য ৫০ মিলিয়নের পরিবর্তে ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যস্বরূপ প্রদান করেন। তাছাড়া, সে প্রতিনিধি দলটি কানাডার সাধারণ জনগণ ও অন্যান্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকেও আহবান জানিয়েছিল বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

এই আবেদনের প্রেক্ষিতে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো পাকিস্তানের উপর অস্ত্র অবরোধ আরোপ করেন। তাছাড়া, তিনি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতে থাকে৷ যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। কানাডায় অবস্থানরত বায়োটেক নির্বাহী শোয়েব সাঈদের “পিয়েরে থেকে জাস্টিন ট্রুডো এবং বাংলাদেশ” প্রবন্ধে থেকে জানা যায় ট্রুডো বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাস করতেন কিন্তু তা অবশ্যই স্বাধীনতাকে সাথে নিয়ে। তিনি অবশ্যই আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাদের নীতিকে অন্ধভাবে অনুকরণ করতে চাননি। তাই তিনি সে সময় দুঃসময়ে বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তাছাড়া, সে সময় কানাডার রাজধানীর অটোয়ার সাথে ইসলামাবাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ছিল৷ ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ রিচার্ড পিলকিংটনের “In the national interest? Canada and the East Pakistan crisis of 1971” বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, কানাডা ছিল পাকিস্তানের উন্নয়ন সহায়তার সরবরাহকারী এবং পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পের অংশীদার। তবে ট্রুডো পাকিস্তানের প্রতি কঠোর না হয়ে চতুর্সূত্রীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের প্রতি সংযত হওয়ার আহ্বান, মানবিক সহায়তা, ত্রাণ বিতরণ, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে উৎসাহ প্রদান ও গণ-নিরপেক্ষতা ছিল এই নীতির মূলভিত্তি।

বাংলাদেশকে প্রথম দিকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে কানাডা একটি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরেও ট্রুডোর বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন অব্যাহত ছিল৷ বাংলাদেশ যেন কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করতে পারে সে ব্যাপারেও ট্রুডো সমর্থন জানিয়েছিলেন ।

পিয়েরে ইভস ইলিয়ট ট্রুডো মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময় যেভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহায়তা করেছিলেন সে কথা আজীবন বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন স্বরূপ তাকে মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও পিয়েরে ট্রুডোর পুত্র জাস্টিন ট্রুডোর হাতে ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিলে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মাননা তুলে দেন।

Similar Posts