বই, বই এবং বই (১) – লাইব্রেরির প্রতি ভালোবাসা
আমেরিকায় প্রথম আসার পরে এক বিকেলে আমাদের স্থানীয় লাইব্রেরিতে গেলাম লাইব্রেরি কার্ড করার জন্য। কার্ড হাতে দিয়ে লাইব্রেরিয়ান বলল, -আজ তোমার প্রথম দিন তাই তুমি ৬টা বই নিতে পারবে; এরপর থেকে প্রতিবার কার্ড দিয়ে একেবারে ২১টা করে বই নেয়া যাবে। সেদিন ৬টা বইই নিয়েছিলাম আমার মেয়ের জন্য। এতো সুন্দর রঙিন সব ছবির বই যে সেগুলো দেখে নিজের শিশুকালে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিল। তবে না ফিরতে পারলেও আক্ষেপ নেই, কারণ মেয়েকে সেসব বই আমাকেই পড়ে শোনাতে হয়।
এরপর থেকে লাইব্রেরিতে আমাদের যাতায়াত নিয়মিত হয়ে গেল। লাইব্রেরিটা আয়তনে খুব বড় না হলেও শিশুদের এবং বড়দের বইয়ের সেকশন সেখানে আলাদা, দু’টো দুই পাশে। লাইব্রেরিতে সপ্তাহে তিনদিন শিশুদের জন্য “স্টোরিটাইম” র আয়োজন করা হয় যেখানে লাইব্রেরিয়ানরা বাচ্চাদের গল্পের বই পড়ে শোনান। গল্প শোনানো হতো লাইব্রেরির ভেতরে স্টোরিটাইম ক্যাসেলে যেটা রূপকথার সব চরিত্রদের ছবি দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। তবে সব শিশুই যে চুপচাপ বসে গল্প শুনতো তা নয়। একটু বড় শিশুদের গল্প শোনায় মনোযোগ থাকলেও ছোটরা সেই সময়টায় অন্যদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরীতে বেশি আগ্রহী থাকত। গল্প শোনা শেষে প্রতিদিন সহজ এবং সাধারণ কিছু ক্রাফটিং থাকতো যা করে বাচ্চারা বেশ আনন্দ পেতো। আর একসাথে ছবি আঁকা, সবাই মিলে ছড়া বলা বা গান গাওয়া এসব তো ছিলই। এইসব মিলিয়ে শিশুরা খুব উপভোগ করতো সেই সময়টুকু। অন্যান্য সময় লাইব্রেরি নীরব থাকলেও সেই স্টোরিটাইমের সময়টুকুতে বাচ্চাদের কিচিরমিচিরে লাইব্রেরি ভরে উঠতো। স্টোরিটাইমের দিনগুলোতে আমাদের তাড়া থাকত লাইব্রেরিতে যাওয়ার। আমার মেয়ে এতোটাই আনন্দ পেতো যে লাইব্রেরিতে যাবার কথা শুনলেই সে ভীষণ খুশি হয়ে উঠত। পাবলিক লাইব্রেরির পাশাপাশি ইউনিভার্সিটির ভেতরের লাইব্রেরিও সাপ্তাহিকভাবে শিশুদের জন্য গল্প শোনানোসহ বয়স উপযোগী কিছু খেলার আয়োজন করত।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অর্থাৎ শনিবার এবং রবিবারে লাইব্রেরি খোলা থাকলেও কোন স্টোরিটাইম হতো না। সেসব দিনে আমরা মাঝেমাঝে চলে যেতাম আমাদের ছোট্ট শহরের বইয়ের দোকান “Barnes & Noble” (বারনেস এন্ড নোবল্) এ; ছুটির দিনগুলোতে তারা স্টোরিটাইমের আয়োজন করতো। সেখানেও শিশুদের বইয়ের সেকশনটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো। আমার ঘোরাঘুরির পরিধি সীমিত, খুব বেশি লাইব্রেরি বা বুকশপে যাবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এই বুকশপটা এখনো পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর বইয়ের দোকান। এতো সুন্দর করে সব বই সাজানো গোছানো যে দেখলেই কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে। জনপ্রিয় বইগুলোর দামি সংস্করণের পাশাপাশি স্বল্পমূল্যের কাগজের কমদামি সংস্করণও সেখানে থাকে যেন সবধরনের ক্রেতা কেনার সুযোগ পায়। আর বছরজুড়ে ডিসকাউন্টও চলতেই থাকে-বই কেনাতে অন্তত অর্থ যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সেখানে বসে যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ বই পড়া যায়, তাড়া দেবার কেউ নেই।
আমেরিকার শীতকালটা মোটামুটি ভয়ঙ্কর। দিনের পর দিন বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ আর তীব্র বাতাসের দাপটে বাহিরে যাওয়ার সুযোগ খুব কম থাকে। ছোট্ট বিকেল শেষের দীর্ঘ রাতগুলোতে যখনই একঘেয়েমি পেয়ে বসত, তখনই আমরা লাইব্রেরি অথবা বুকশপে চলে যেতাম, সময়গুলো খুব ভালো কাটত।