যৌতুক
ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার আগের দিন দেখি আমার ব্যাগের ফুটোগুলো বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। নতুন একটা ব্যাগ না কিনলেই নয়। টাকা পয়সা বলতে দুটো একশ টাকার নোট। এত কম টাকায় একটা ব্যাগ জুটবে না। তবে আশার কথা হলো আজকে টিউশনির টাকাটা হাতে পাবো।
আমার একটা মাত্র টিউশনি আছে। ছাত্রের নাম “অংকন”। তাই বলে আঁকাআকি একদম পছন্দ করে না। পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী। তার চেয়ে বড় কথা হলো রেজাল্ট ভাল করে।বর্তমান সময়ের বাবা- মা একজন হোম টিউটরের কাছে শুধুমাত্র রেজাল্টটাই আশা করে। আমার আরও একটা টিউশনি ছিল। ক্লাশ এইটে পড়ত ছেলেটা। জেএসসি পরীক্ষায় ৪.২৫ পেয়েছে। এজন্য টিউশনিটাও চলে গেছে। কারণ বাবা এত টাকা দিয়ে হোম টিউটর রেখেছিল শুধুমাত্র এ+ পাওয়ার আশায়। এখন আত্মীয় স্বজনের সামনে মুখ দেখাবে কি করে। কিন্তু বড় ক্ষতিটা আমার হয়ে গেল।
আগামীকাল থেকে কুরবানীর বন্ধ দিয়ে দেব। আজকে যাচ্ছি বেতনটা আনার জন্য। গত কালকেই বলে রেখেছি বেতনের কথা। মিরপুর এগারো থেকে দশ নম্বরের উদ্দেশে রওনা হলাম।
অংকনদের বাসায় এসে কলিং বেলে নক করা করলাম। ভেতর থেকে কাজের মেয়েটা এসে দরজা খুলল৷ বলল, ” স্যার আইয়েন, সোফায় বহেন, আমি আফারে ডাকতাসি”। আমি সামনের রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আন্টি আসলেন।কিছু না বলেই হাতের মধ্যে একটা খাম পুরে দিলেন। তারপর চলে গেলেন।
আমি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। এ কারনে নয় যে আন্টি কিছু জিজ্ঞেস না করে চলে গেলেন। হয়ত বিশেষ কোন কাজে ব্যাস্ত আছেন। আমার বিরক্তির জায়গাটা অন্য জায়গায়। স্কুল বন্ধের আগেরদিন স্যাররা আমাদের কয়েক সাগর উপদেশ দিতেন। এই যেমন ধরেন, “বন্ধের সময়টা যত পড়বে তত এগিয়ে থাকবে, বন্ধ কিন্তু বেড়ানোর জন্য দেওয়া হয়,খেলাধুলা করে কাটানোর জন্য দেওয়া হয় না বরং বেশি বেশি পড়ার জন্য দেওয়া হয়, বন্ধের সময়টা একেবারেই নষ্ট করবে না” আরো কত কি! আবার এসব অমীয় বানীর সাথে সাথে কয়েক বস্তা বাড়ির কাজও দিতেন। এজন্য ছোট বেলা থেকে নিয়ত ছিল আমি যদি কোনদিন শিক্ষক হতে পারি তাহলে আমিও আমার ছাত্রকে এসব উপদেশ দেব। এমনকি উপদেশ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রস্তুতিও নিয়ে আসা হয়েছে৷ কিন্তু সেটা আর হলো না।
বাসা থেকে বের হওয়ার পর খাম খুলে দেখি দুটো এক হাজার টাকার নোট ও একটি পাঁচশ টাকার নোট। বাহ! বেতনের সাথে বোনাসও আছে!! আমার জন্য অবশ্য মূল বেতনের টাকাটা হাতে পাওয়াই ছিলো অনেক প্রতিক্ষার ব্যপার।
এখন মেসে যাওয়ার পালা। একটা রিক্সা ঠিক করলাম। অন্যান্য সময় বাসে করে যাই। বাস ভাড়া পাঁচ টাকা। যেদিন টিউশনির টাকা হাতে পাই সেদিন রিকশায় করে যাই। রিকশা ভাড়া বিশ টাকা। দুদিন আগেও রিকশা ছিলো পায়ে চালানো বাহন।এখন অধিকাংশ রিকশায় মোটর যোগ হয়েছে। রিকশাওয়ালারা পায়ের ওপর পা তুলে বসে আরামসে রিকশা চালাতে পারে।
রিকশায় চড়লে আমি আবার চুপ থাকতে পারি না। রিকশাওয়ালা মামার সাথে গল্প করতে করতে যেতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আমি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা বাড়ি যাবেন কবে?
– এ্যা??
– বলছি এবার ঈদে বাড়ি যাবেন না?
– না ভাই যাওয়া হইবো না
– কেন যাওয়া হবে না মামা?
– যাইতে পারমু না
– কেন? টাকা পয়সা সমস্যা?
– না ভাইজান। হ্যার চাইতে বড় সমেস্যা।
– কি হইছে বলেন তো? বাড়িতে কিছু হয়েছে?
– আরে ভাইজান বইল্লেন না। অনেক সুখ-দুকখের কতা…..
ওনি একাধারে বলতেই লাগলেন। মূল ব্যপারটা এরকম, উনি বাড়ি যেতে পারবেন না কারণ ওনার বোনের বিয়ে৷ বোনের বিয়েতে কে না থাকতে চায়!! কিন্তু ওনার দূরে থাকতেই হবে। সেটার কাহিনী আরেকটু গভীর। এই বেচারা গ্রামের বাড়িতে বসে কৃষি কাজ করতেন। সামান্য জমিতে চাষাবাদ, অন্যের জমিতে বদলা খাটার মধ্য দিয়ে দিনকাল কোনমতে চলছিল।
বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে এক সুপারী ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে। অনেক বড় ঘরের ছেলে। কথাবার্তা পাকা হওয়ার পর ছেলের একটাই দাবী, বিয়েতে উপহার হিসেবে তাকে একটা মোটরসাইকেল দিতে হবে। সেই মোটরসাইকেল কেনার টাকা জমানোর জন্য দিনের পর দিন রিকশা চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু বোনের বিয়েতে তিনি নিজেই যেতে পারবেন না। কারণ, কেউ না কেউ যদি জেনে যায় যে, মেয়ের ভাই রিকশা চালায়, তাহলে বিবাহ ভেঙ্গে যেতে পারে এই ভয়ে!
আমি আর কথা বলার আগ্রহ পেলাম না। ঘরর ঘরর শব্দে এগিয়ে চলছে তিন পায়ের রিকশা। চুপচুপ বসে ভাবছি,এত বৈচিত্র্যময় জীবন আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়!!!
আমি রিকশা থেকে নেমে মামার হাতে একটা এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম। সাথে আরেকটা বিশ টাকার নোট৷ রিকশাওয়ালা টাকাটা ফিরিয়ে দেয়ার মত একটা ভঙ্গি করলেন। উনার মুখ থেকে কিছু বের হওয়ার আগেই আমি বলে বসলাম, এই টাকাটা আমি তাকে ভিক্ষা হিসেবে দিচ্ছি না কিংবা কোন সাহায্য করছি না৷ বরং আমি ওনার বোনের বিয়ের দাওয়াত খেতে চাই। যেহেতু আমি নিজের ইচ্ছায় দাওয়াত খাবো, সেহেতু আমার ভাগের খরচটা আমি দিতে চাচ্ছি।
উনি প্রশ্ন করলেন, কেন আমি ওনার বোনের বিয়ে খেতে চাইছি??? উত্তরে বললাম, আমি আসলে ওই হবু জামাইকে একবার দেখতে চাই যে নিজের দ্বিতীয় জীবনে প্রবেশ করতে চায় একটা মোটরসাইকেল যৌতুকের বিনিময়ে।
অত্যন্ত সাবলীল ও সুন্দর লেখনী। লেখককে অনেক শুভ কামনা!
আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ
Masa-Allah….. lovely brother
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই আপনাকে