সায়ানাইড: রহস্যময় এক বিষের নাম

বিভিন্ন গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস, সাহিত্য ইত্যাদিতে আমরা সায়ানাইডের উল্লেখ দেখতে পাই। সাধারণত গল্পে বা উপন্যাসে সায়ানাইডকে রহস্যময় একটি বিষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়াও গুজব প্রচলিত আছে যে, সায়ানাইডের স্বাদ কেমন, তা কেউ জানেনা কারণ সায়ানাইড মুখে দিলে সাথে সাথেই মৃত্যু নিশ্চিত। আর তাই যন্ত্রণা-বিহীন ‘সুইট ডেথ’ এর জন্য অনেকেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করে। সব মিলিয়ে গল্প, উপন্যাস আর গুজবের বদৌলতে সায়ানাইডকে ঘিরে সাধারণের মনে এক ধরনের রহস্য বা কৌতুহল কাজ করে থাকে।

সায়ানাইড

সায়ানাইড আসলে কী?

C≡N মূলক বিদ্যমান থাকে, এমন রাসায়নিক যৌগকে সায়ানাইড বলা হয়। অনেক পদার্থই কার্বন-নাইট্রোজেন (CN) বন্ড তথা সায়ানো গ্রুপ ধারণ করে থাকে। তবে সায়ানো গ্রুপ ধারণকারী সকল যৌগই যে মারাত্মক ক্ষতিকর বা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী, তা কিন্তু নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- হাইড্রোজেন সাইনাইড ( HCN ), সোডিয়াম সাইনাইড ( NaCN ), পটাসিয়াম সাইনাইড ( KCN ) ইত্যাদি হলো যথাক্রমে হাইড্রোজেন, সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের সাথে যুক্ত সায়ানো গ্রুপ। এগুলো মারাত্মক ক্ষতিকর এবং বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী। অপরদিকে, নাইট্রিল নামক সায়ানো গ্রুপের কিছু যৌগ রয়েছে, যেগুলোকে ক্ষতিকর ও বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়না। কারণ, নাইট্রিল সায়ানাইড থেকে সহজে সায়ানো মূলক আলাদা হতে পারেনা। ফলে বিষক্রিয়া সৃষ্টির জন্য বিপাকীয় বিষ তৈরি হয়না। ঔষধ তৈরিসহ নানা ধরনের কাজে নাইট্রিল সায়ানাইড ব্যবহার করা হয়।

সায়ানাইড
বোতলে রাখা সায়ানাইড।

সায়নাইড গ্রহন করলে মানুষ কিভাবে মারা যায় 

সায়ানাইডের কারণে দেহকোষগুলো অক্সিজেন থেকে শক্তি উৎপাদন করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সায়ানাইড যৌগমূলক বা আয়ন (CN-) কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার সাইটোক্রোম সি-তে অবস্থিত লোহার সাথে যুক্ত হয়ে তাকে আটকে রাখে। এতে করে সাইটোক্রোম সি অক্সাইডেজ অক্সিজেনে ইলেকট্রন পরিবহণ করতে পারে না। অক্সিজেন পরিবহন না হওয়ায় মাইটোকন্ড্রিয়াতে অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট বা এটিপি তৈরি হতে পারেনা। এডিনোসিন ট্রাই ফসফেট বা এটিপি এবং এডিনোসিন ডাই ফসফেট বা এডিপি’র ভাঙ্গন- গড়নের মাধ্যমেই আমাদের শরীরে শক্তির সরবরাহ হয়। অক্সিজেনের অভাবে যেহেতু অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেটই উৎপন্ন হচ্ছেনা, তাই দেহে শক্তি সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। শক্তি উৎপাদনে ব্যর্থ হওয়ায় হৃৎপিণ্ডের পেশিকোষ এবং স্নায়ুকোষগুলো দ্রুত তাদের শক্তি খরচ করে ফেলে আর মারা যেতে শুরু করে। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কোষগুলো মারা গেলে সেই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো যেমন- হৃৎপিন্ড, মস্তিষ্ক, ফুসফুস ইত্যাদি অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

প্রশ্ন হলো- সায়ানাইড খেলে সাথে সাথেই কি মানুষ মারা যায় ? সাথে সাথেই মারা যাওয়ার কারণে যন্ত্রণা ছাড়াই কি মৃত্যুর সাথে হাত মেলানো যায় ? গল্প, গোয়েন্দা উপন্যাস ইত্যাদিতে সায়ানাইডকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়, তাতে এমন প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়াটা মোটেও অবান্তর নয়। আবার, সায়ানাইড খাওয়ার পরও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় আছে কি ?

সায়ানাইড খাওয়ার কারণে সাথে সাথেই মৃত্যু হয়ে যাওয়ার কথাটি একটি ভুল ধারণা মাত্র। বাস্তবে, কোনো বিষাক্ত কিছু খেয়ে ফেলার পর সাধারণত খুব দ্রুতই রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় এবং তারপর ১০-২০ মিনিট পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

মুখের মাধ্যমে সায়ানাইড শরীরে প্রবেশের পরে অক্সিজেন ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং কোষগুলোতে একটি বিপাকীয় ব্যাধি তৈরি করে। আবার, রক্তে উপস্থিত থাকা লোহা বা অন্য কোন ধাতুর সাথে সায়ানাইড ক্রিয়া করে। ফলে সায়ানো গ্রুপের একটি ভারী যৌগ গঠিত হয়। তাই রক্তের তরলতা হ্রাস পায়।

উপরোক্ত দুটি কারণে সায়ানাইড খেয়ে ফেলার পর একজন ব্যক্তি প্রথমে অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর খুব তাড়াতাড়িই তিনি মারা যান। সায়ানাইড খাওয়ার পর অজ্ঞান অবস্থায় মারা যাওয়ার কারণে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভূত হয়না। তাই কষ্ট ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি। সায়ানাইডের বিষাক্ততার কারণে মৃত্যুহার হয় প্রায় ৯৫% । সময়মতো সালফার অ্যান্টিডোট দেওয়া সম্ভব হলে সায়ানাইড বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো যেতে পারে। কারণ রাসায়নিক পদার্থটি তখন নিরপেক্ষ হয়ে যায়। তবে বেঁচে যাওয়ার পরও উক্ত ব্যক্তি মস্তিষ্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের নানা ধরনের সমস্যা, এমনকি অনেক সময় পারকিনসন রোগেও ভুগেন।

সায়ানাইডকে বিভিন্ন সাহিত্যে এবং মুভি কিংবা সিরিয়ালে যেভাবে রহস্যময় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, তাতে এই বিষ সম্পর্কে মানুষের মনে কৌতুহল জমা  স্বাভবিক এবং এর ফলে ক্ষেত্র বিশেষে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে, এটিই সবচেয়ে মারাত্মক বিষ অথচ সায়ানাইডের চেয়ে আরো মারাত্মক বিষও রয়েছে। তাই বহুল প্রচলিত কোন বিষয়ে যে কোন তথ্য পেলেই তা সঠিক ভাবা ঠিক নয় বরং তার সত্যতা যাচাই করা উচিত। আজ এ পর্যন্তই। ভবিষ্যতে আবার হাজির হবো অন্য কোন বিষয় নিয়ে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

Similar Posts