বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (দ্যা ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল)
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই কোন। ট্যাবলেট পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলের সুবাদে এই ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে গল্পেরও অভাব নেই।এসব গল্পের কারণে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অনেকের কাছেই ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভূজ নামেও পরিচিতি পেয়েছে।
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় ২৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত। নামের সাথে ট্রায়াঙ্গেল থাকার কারণ এই এলাকার ব্যপ্তি তিন দিকে তিনটি স্থল ভাগ দ্বারা চিহ্নিত। বারমুডা, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা এবং ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পুয়ের্তো রিকো এই তিনটি স্থানকে যুক্ত করলে যে ত্রিভুজ পাওয়া যায় তার নামই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।পত্রিকা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই এলাকায় একাধিক জাহাজ এবং উড়োজাহাজ আচমকা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
১৯৪৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর ফ্লোরিডার ফোর্ট লডিরডেল এয়ারপোর্ট থেকে উড়া এ্যাভেঞ্জার মডেলের ৫টি টর্পেডো বোমারু জঙ্গি বিমান মহড়া দেবার সময় হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। নিখোঁজ হওয়ার সময় বিমানগুলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আকাশ সীমা অতিক্রম করছিল। আর শেষ মুহূর্তে পাঠানো বার্তা অনুযায়ী বিমান গুলোতে থাকা কম্পাস সেই সময় কোনো কাজই করছিল না। আরও আঁতকে ওঠার মতো ঘটনা হলো বিমানগুলো নিখোঁজ হওয়ার পর মার্কিন নৌবাহিনী দুর্ঘটনাস্থলে তল্লাশি এবং উদ্ধার অভিযান চালায়। সেই অভিযানে অংশ নেয়া মেরিনার মডেলের একটি তল্লাশি বিমানও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আকাশসীমায় থাকা অবস্থায় নিখোঁজ হয়ে যায়।ওই সময় মেরিনার বিমানটিতে তেরজন ক্র ছিলেন।এ ঘটনার পরই মূলত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে ওঠে।পরবর্তীতে অবশ্য নৌবাহিনীর চালানো এক তদন্তে জানা যায় ফ্লাইট কন্ট্রোলারের হিসাবে ভুল থাকায় মহড়ায় অংশ নেয়া বিমানগুলোর জ্বালানি মাঝপথে শেষ হয়ে গেছিল।মেরিনার বিমানটিতে সম্ভবত যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আগুন ধরে গিয়েছিল। ওই অগ্নিকাণ্ডে বিমানটি সাগরে বিধ্বস্ত হয়। এর পরপরই দুর্ঘটনাস্থলে আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হয়ে ওঠায় দীর্ঘস্থায়ী তল্লাশি অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। বিশ্বব্যাপী ঘটনাটি ফ্লাইট ১৯ নামে পরিচিত।
১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্লোরিডা ভিত্তিক দৈনিক পত্রিকা মিয়ামি হেরাল্ড (MIAMI HERALD)প্রথমবার “বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল” নামটি ব্যবহার করে। এডোয়ার্ড ভ্যান উইঙ্কল জোন্স নামক এক প্রতিবেদকের লেখা ওই সংবাদে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় হারিয়ে যাওয়া একটি জাহাজ ও কয়েকটি উড়োজাহাজের কথা তুলে ধরা হয়। তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে আলোচিত করে তোলেন মার্কিন সাংবাদিক ভিনসেন্ট গ্যাডিস।তিনি এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। এরপরে “ইনভিজিবল হরিজন্স” (INVISIBLE HORIZONS)নামে পূর্ণাঙ্গ একটি বই লিখে ফেলেন। এর পরেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্য মানুষের কল্পনার জগত দখল করে ফেলে।
জোন্স এর সেই প্রতিবেদনে যে জাহাজটির কথা উল্লেখ হয়েছিল তার নাম ইউ এস এ সাইক্লোপস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর বার্বাডোজ দ্বীপ থেকে ছেড়ে যাবার পর ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ মার্কিন নৌবাহিনীর এই পণ্যবাহী জাহাজ টি বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। দুর্ঘটনার সময় সে জাহাজে থাকা তিন শতাধিক নাবিক অথবা সেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ এর কোন চিহ্ন এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর কারণ হিসেবে অনেকেই অনেক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। তবে অনেকের মতেই ওই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলায় জার্মান কোন ইউ বোট এর আক্রমণে ইউ এস এ সাইক্লোপস ডুবে যেতে পারে। অবশ্য জার্মানি এ দায় সবসময়ই অস্বীকার করে এসেছে।অন্যদিকে আবহাওয়াবিদদের হিসেবমতে আটলান্টিক মহাসাগরে সৃষ্ট প্রায় সব ঘূর্ণিঝড়ই এই ট্রায়াঙ্গেল অতিক্রম করে।ফলে এখানে সমুদ্র আচমকাই উত্তাল হয়ে উঠতে পারে,যা অতিক্রমকারী জাহাজের জন্য ধ্বংসের কারণ হতে পারে। অন্য একটি থিওরি অনুযায়ী,জাহাজটিতে থাকা পণ্যও ওই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে। দুর্ঘটনার সময় জাহাজে ১১ হাজার টনের মতো ম্যাঙ্গানিজ রাখা ছিল। আগুনের সংস্পর্শে এলে এই ম্যাঙ্গানিজ বিস্ফোরিত হয়ে বড় অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি করতে পারে।
আরও অনেক লেখকই নিজ নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে এ বিষয়ে বই লিখেন, তারা হলেন জন ওয়ালেস স্পেন্সার, তিনি লিখেন “লিম্বো অফ দ্যা লস্ট” (Limbo of the Lost, 1969, repair. 1973), চার্লস বার্লিটজ লিখেন “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”(The Bermuda Triangle, 1974), রিচার্ড উইনার লিখেন “দ্যা ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল” (The Devil’s Triangle, 1974), এছাড়া আরও অনেকেই লিখেছেন।এরা সবাই ঘুরেফিরে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাই বিভিন্ন স্বাদে উপস্থাপন করেছেন।
তবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্পটি সম্ভবত বিমানচালক ব্রুস গারনন এর মুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে।তার ভাষ্য অনুযায়ী ১৯৭০ সালের এক ঝক ঝকে দিনে তিনি দুই যাত্রী সহ বারমুডা থেকে ফ্লোরিডা আসছিলেন। কিন্তু আকাশে উড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বজ্রপাতসহ এক ঘূর্ণিঝড় তার হালকা বিমানটিকে ক্রাশ করে ফেলে। ওই সময় তার বিমানের চারপাশে বাতাসের ঘূর্ণিপাক বইছিল আর কেবল বিদ্যুৎ চমকের নীল ঝলক দেখা যাচ্ছিল। যথারীতি বিমানের কম্পাস এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতিও বিদঘুটে আচরণ শুরু করে। এই সময়ে ব্রুস এবং তার বিমানের দুই যাত্রী প্রাণের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। এমন সময় ব্রুসের চোখে ঘনঘটা মেঘের মধ্যে সরু এক সুরঙ্গ পথ ধরা পড়ে।সাথে সাথে সেই সুরঙ্গে তিনি নিজের বিমানটিকে ঢুকিয়ে দেন। এরপরে বিমানটির গতি অসম্ভব মাত্রায় বেড়ে যায়। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই ব্রুস এর বিমানটি বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলে। এই পুরো সময়টা ভূপৃষ্ঠে থাকা টাওয়ারগুলো তাদের র্যাডারে বিমানটির কোন চিহ্নই দেখতে পাচ্ছিল না।
সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় ঘন কুয়াশার মুখোমুখি হন। তার ভাষ্য অনুযায়ী মাত্র ২ মিটার দূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছিল না অর্থাৎ পুরোপুরি অনুমানের উপর ভিত্তি করে তিনি বিমানটি চালাচ্ছিলেন। সৌভাগ্যবশত কিছুক্ষণ পর কুয়াশা কিছুটা হালকা হলে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের রাডারে ব্রুসের বিমানটি ধরা পড়ে। এরপর নিরাপদেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যান ব্রুস। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর তিনি বুঝতে পারেন যে যাত্রায় অন্তত দেড় ঘন্টা লাগার কথা সেটুকু পর তিনি মাত্র ৪৫ মিনিটে পাড়ি দিয়েছেন। অর্থাৎ তার পরিসংখ্যানের হিসাবমতে ঘূর্ণিপাকের মধ্যে ঢাকা বিমানটি ৩ মিনিটে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছিল।অর্থাৎ ওই সময়ে বিমানটি ঘণ্টায় প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার গতিতে উড়ছিল,যা মূলত অসম্ভব। কিন্তু ব্রুস তার দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে জানান যে বিমানবন্দরে অবতরণের পর ফুয়েল ট্যাংকে থাকা জ্বালানির অর্ধেকটাই অবশিষ্ট থেকে গিয়েছিল। ব্রুসের এই গল্পটা এতটাই চমকপ্রদ যে একদিকে কন্সপিরেসি থিওরির প্রচারকরা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মহাজাগতিক শক্তি ডার্ক এনার্জির কথা বলেছে। অন্যদিকে একদল সমালোচক পুরো ঘটনাটাকেই আষাঢ়ে গল্প আখ্যা দিয়েছে।
এসব ঘটনা ও দুর্ঘটনার কারণে বিজ্ঞানীরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সাগর,আবহাওয়া নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করেন। স্বস্তির ব্যাপার হল তাদের এই গবেষণায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অনেক রহস্যের সমাধান পাওয়া গিয়েছে। এসব গবেষণাপত্রের বর্ণনা অনুযায়ী বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অবস্থান বিশ্বের ব্যস্ততম শিপিং রোডগুলোর একটিতে।অর্থাৎ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই এলাকা দিয়ে পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী বিপুলসংখ্যক জাহাজ যাতায়াত করেন। সেই অনুপাতে এখানকার দুর্ঘটনার সংখ্যা তেমন বেশি না। এই এলাকা দিয়ে বিপদজনক ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি গাল্ফ স্ট্রিম(GULF STREAM) নামক স্রোত বয়ে যায়। ভীষণ শক্তিশালী এই স্রোতের কারণে এখানে দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ এবং বিমানের ধ্বংসাবশেষ কখনো একই এলাকায় অবস্থান করে না। শক্তিশালী স্রোতের কারণে তা অনেক দূরে চলে যায়। পাশাপাশি বারমুন্ডা ট্রায়েঙ্গেল এলাকায় সমুদ্রের গভীরতাও অনেক বেশি। ভূতাত্ত্বিকদের হিসেব মতে এখানে সমুদ্রতলের গভীরতা ছয় থেকে আট কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া অনেক বিজ্ঞানীই এই এলাকায় সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য এখানে সাগরজলে মিথেন হাইড্রেট এর উপস্থিতিকেও দায়ী করেছেন। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ গঠনকারী মহাদেশীয় প্লেটগুলোর একটি এখানে সমুদ্র তলদেশের সাথে মিলিত হয়েছে। যে কারণে এখানে খনিজ গ্যাসের একাধিক খনি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ওই খনিগুলো থেকে প্রায় বিপুল পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট গ্যাস নির্গত হয়। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে ফেনার সৃষ্টি হয়। ওই ফেনাযুক্ত পানিতে জাহাজ গুলো ভেসে থাকতে পারে না। ফলে তারা আচমকা তলিয়ে যায়। আর ডুবে যাওয়া জাহাজ গুলো সাগরতলের গভীরতা এবং শক্তিশালী গালফ স্ট্রিমের কারণে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায়।
একবিংশ শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। তারপরেও কিছু মানুষ এখনো সেই আদিভৌতিক ব্যাখ্যা ও কন্সপিরেসি থিওরি তে বিশ্বাস করে। বিজ্ঞান এ ধরনের মানুষের কাছে যত ব্যাখ্যাই হাজির করুক না কেন,বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এদের কাছে আজীবনই রহস্য থেকে যাবে।