আলোর ফেরিওয়ালার সঙ্গে একদিন
যে কিনা নিজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হয়েও মানুষকে বই পড়ানোর প্রতি এত আগ্রহী,তাঁকে কাছে থেকে দেখার ও তাঁর সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর খুব ইচ্ছে ছিল আমার। হঠাৎ বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা আলোর ফেরিওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে যাব। হ্যাঁ,যেই কথা সেই কাজ। বেরিয়ে পড়লাম সবাই। হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে আমাদের যাত্রার একটু ব্যাঘাত ঘটেছিল। কিন্তু তারপরেও আমরা যাচ্ছিলাম। কিন্তু সমস্যা বাঁধল রাস্তা নিয়ে। কারণ আমরা তো উনার বাড়ির রাস্তা চিনতাম না।
অবশেষে বাউসা বাজারের আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করে কোনোমতে পৌঁছালাম কাংখিত স্থানে।সেটা ছিল তাঁর লাইব্রেরী। বৃষ্টির কারণে চারপাশটা একদম নিস্তব্ধ।মাঝেমধ্যে এক-আধ জন মানুষ রাস্তা দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিল।আমরা ক’জন বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর লাইব্রেরীর দায়িত্বরত আপু (পলান সরকার-এর নাতনী) কে দেখলাম কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন। আমরা তাকে ডেকে কথা বললাম। সময়টা দিনের মাঝামাঝি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই সময় বিশ্রাম নিচ্ছিল।আপু বললেন তিনি এই সময় বাড়িতে থাকেন।তাঁর সঙ্গে এখন দেখা করতে হলে তাঁর বাসায় যেতে হবে। স্যারের বাড়ি লাইব্রেরী থেকে পাঁচ মিনিটের পাঁয়ে হাঁটার পথ। তাই গ্রামের রাস্তা দিয়ে আমরা ক’জন চললাম তাঁর বাড়ির দিকে। সঙ্গে রয়েছেন সেই আপু। আমরা সেখানে গিয়ে দেখলাম তিনি ঘরের ভেতরে শুয়ে আছেন। ভেতরে গিয়ে খবর দেওয়ায় তিনি উঠে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। সেদিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছিল তাই বাড়ির সামনের রাস্তাটা কর্দমাক্ত ছিল। উনার এক আত্মীয় হাত ধরে সেই জায়গাটা পার করে দিতে চাইলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তারপর আমরা আমাদের পরিচয় দেই। এরপর তিনি আমাদের লাইব্রেরী দেখানোর জন্য নিয়ে গেলেন।যখন আমরা সবাই সেই পাঠাগারে প্রবেশ করলাম তখন মুগ্ধ হচ্ছিলাম বারবার এবং মনে হচ্ছিল এইরকম একটা জায়গায় এমন একটা লাইব্রেরী কীভাবে গড়া সম্ভব?এখনকার ব্যস্ত জীবনে যেখানে মানুষের জন্য কিছু ফাঁকা সময় বের করাটাই খুব কঠিন, তখন এই অজপাড়া গাঁয়ে বসে তিনি এক আশ্চর্য রকম জ্ঞান ভান্ডার তৈরী করে ফেলেছেন, তাও আবার নিজের কৃতিত্বে।
লাইব্রেরীর ভেতরের তাকগুলোতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন ধরনের বই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুতোষ,সাহিত্য,কবিতা,উপন্যাস,মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ আরোও কত কি!তিনি নিজে দেখে দেখে বলে দিচ্ছিলেন আমাদেরকে যে কোন বইটা পড়লে আমরা মজা পাবো, কোন কোন বইয়ে কি বলা হয়েছে ইত্যাদি। তাকগুলো যে শুধু বই দিয়ে-ই সাজানো তা কিন্তু নয়,সেখানে আরোও স্থান পেয়েছে বিভিন্ন ধরণের স্মৃতিচারণমূলক ছবি। এই সব ছবির মধ্যে একটি হল তাঁর পুরস্কার লাভের ছবি। ২০১১ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য তিনি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্মান লাভ করেন যেটি হল ‘একুশে পদক’। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই পুরস্কারটি তাঁর হাতে তুলে দিচ্ছিলেন ,সেই সময়টি এই ফ্রেমে বন্দী রয়েছে। এইভাবে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা কিছু স্মৃতি আর অনেক অনুপ্রেরণা নিয়ে রওনা দিলাম আমাদের বাড়ির পথে।সেদিন (১ লা মার্চ) সন্ধ্যায় যখন টেলিভিশনে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম,তখন প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনি আমাদের মাঝে আর নেই।এই রকম একজন গুণী ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা বন্ধুমহল গভীরভাবে শোকাহত। এখন শুধু একটাই প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার কাছে যেন পরপারে গিয়েও ভাল থাকেন আলোর ফেরীওয়ালা।