বায়ুদূষণ: সমস্যা ও সমাধান

বায়ুদূষণ কি? পরিবেশকে ভৌত পরিবেশ, জৈব পরিবেশ এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ভৌত পরিবেশের অন্যতম উপাদান বায়ুমন্ডল। আমাদের চারদিক ঘিরে বায়ুর যে আবরন আছ তাকে বায়ুমন্ডল বলে। আয়তন হিসাবে বায়ুর বিভিন্ন উপাদাগুলোর শতকরা হার নিম্নরূপ –
নাইট্রোজেন ৭৮.০২ হার, অক্সিজেন ২০.৭১ হার, আরগন ০.৮০ হার, জলীয়বাষ্প ০.৪১ হার, কার্বন ডাই অক্সাইড ০.০৩হার, অসাধারণ গ্যাসসমূহ ০.০২ হার, ধূলিকণা ও উদ্ভিদকণা ০. ০১।

 যে প্রক্রিয়ায় ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাস বা পদার্থ বায়ুতে মিশে জীব-জগতের স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাড়ায় তাকে বায়ুদূষণ বলে। এর ফলে স্বাস্থ্যের সমস্যা হতে পারে, পরিবেশ ও সম্পদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বায়ুদূষণের ফলে ওজোনস্তর পাতলা হয়ে গেছে যা থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি কেবল স্বাদু পানির উৎস হিসাবে কাজ করছেনা, এসিডের মিশ্রনসহ আকাশ থেকে নেমে আসছে বৃষ্টির পানি। এতে ভীষন ক্ষতি হচ্ছে স্থলজ ও জলজ পরিবেশের। এসিড বৃষ্টির পানি মিশে যায় নদী ও হ্রদের পানিতে।মাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়,মাটির অম্লতা বৃদ্ধি পায়,জমির উর্বরতা হ্রাস পায়, গাছপালার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বহু জলচর জীবের মৃত্যু ঘটে।নির্মল বায়ু যেমন মানুষকে বাঁচাতে পারে তেমনি দূষিত বায়ু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

air_pollution

বায়ুদূষনের উৎসঃ বায়ুদূষণ উৎপাদনকারী সংক্রামক বস্তু প্রধানত দুটি উৎস হতে উৎপন্ন হয়।

ক. প্রাকৃতিক উৎস

খ.মানবসৃষ্ট উৎস।

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, বনে আগুন, ধূলিঝড়,মৃত ও পচনশীল উদ্ভিদ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূষনের কারন। অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানা,ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া,ভোগবিলাসী জীবন যাপনের জন্য অতিমাত্রায় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও যানবাহনের ব্যবহারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা মানবসৃষ্ট দূষণ। বিশ্ব উষ্ণায়ন (global warming) সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অশনি সংকেত এবং জীববৈচিত্র্যের অস্বস্তি রক্ষার হুমকিস্বরূপ। কার্বন মনোক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, নিকেলযুক্ত গ্যাস, সীসাযুক্ত ধোয়া ইত্যাদি বায়ুদূষণকারী গ্যাস কল-কারখানা অথবা যানবাহন হতে সৃষ্টি হয়। শিল্পায়ন শুরু হবার পর হতেই বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের পরিমান শতকরা বেড়ে চলছে। এছাড়া প্রাকৃতিক উৎস যেমন – আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে সালফার ডাই অক্সাইড ও নানা ধরনের কণা, বনে অগ্নিকাণ্ড থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড,ধূলিঝড় থেকে ধূলিকণা, উদ্ভিদ(মৃত ও পচনশীল) থেকে মিথেন গ্যাস ও হাইড্রোজেন সালফাইড, মৃত্তিকা থেকে ভাইরাস ও ধূলিকণা, সূর্যের অতি বেগুনীরশ্মীর সংযোগে হাইড্রোকার্বন ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে বিষাক্ত ফটো কেমিক্যাল এক্সিডেন্ট তৈরি হয়।

বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণঃ বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি এশিয়া ও ইউরোপে। বার্তা সংস্থা এপি’র বরাত দিয়ে ২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে পাওয়া যায়, প্রতিবছর বায়ুদূষণজনিত রোগে অপরিণত বয়সী প্রায় ২১ লাখ মানুষ মারা যায় বলে নাসার গবেষণায় জানা যায়। বিশাল সংখ্যক এই মৃত্যুর বেশির ভাগই এশিয়া ও ইউরোপে।
নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক গবেষক জ্যাশন ওয়েস্টের দীর্ঘদিনের গবেষণা মতে, ‘ধুলা আর ঝুলের সংমিশ্রণে আড়াই মাইক্রোমিটারের চেয়েও বেশি ছোট একপ্রকার কণার সৃষ্টি হয় যা মূলত বায়ুদূষণের উপাদান। কণাটির এই আয়তনের কারণে এই বস্তুটিকে পিএম ২.৫ নামেও ডাকা হয়। এরা এতই সূক্ষ্ম যে খুব সহজেই মানুষের ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে। গাড়ির কালো ধোয়া সহ শিল্প-কারখানা নির্গত ধোয়াতে এই পিএম ২.৫ এর মাত্রা বেশি।’

ইউরোপের পরিবেশ পর্যবেক্ষনকারী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক দশকে ইউরোপে কার্বন নিঃসরণের হার কমলেও ডিজেলচালিত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। সেইসঙ্গে বাড়িতে গ্যাসের বিকল্প হিসাবে কাঠকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। ফলে কঠিন হয়ে পড়েছে দূষণরোধ করা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে,তাদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের প্রতি নজর না দিলে তা আরও ক্ষতিকর হবে।

বায়ুদূষণ থেকে রোগব্যাধিঃ আমেরিকান জার্নাল অব এপিডেমিওলজির নতুন গবেষনায় জানা যায়, বাতাসকে ভারি করে তোলে সূক্ষ্ম দূষণকারী বস্তুকণা আকস্মিক কার্ডিয়াক এরেস্ট এর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী নিউইয়র্ক শহরের হাসপাতালভিত্তিক ৮২১৬ জন কার্ডিয়াক এরেস্ট এর রোগী পাওয়া যায়।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, বায়ুদূষণ হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কার্ডিওভাস্কুলার মৃত্যুঝুকির একটি বড় কারণ।
হৃদরোগ বায়ুদূষনের অন্যতম কারণ। গবেষক টিম চিকো বলেন, অনেকেই হৃদরোগ আর কিডনি সমস্যাকে বিচ্ছিন্ন মনে করেন। কিন্তু হার্টের সমস্যা থেকেও কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। হার্টের ওষুধ নিয়মিত খেলেও কিডনি সমস্যা হতে পারে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (IARC) এর গবেষনায় দূষিত বায়ু ক্যান্সারের কারণ বলে তথ্য মিলেছে। ২০১০ সালে বিশ্বে প্রায় ২লাখ ২৩ হাজার মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারে মারা যান। দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। ফুসফুসের এ ক্যান্সার ব্লাড ক্যান্সারের ঝুকিও বহন করতে পারে বলে গবেষণায় এমন প্রমান মিলেছে।

বায়ুদূষণ প্রতিরোধঃনিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহনের মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধ করা যেতে পারে,
-কালো ধোয়া উৎপাদন করে এমন যানবাহন ব্যবহার বন্ধ করা।
-ইটের ভাটা লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করা।
-কম জ্বালানি ব্যবহৃত হয় এমন উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার করা। যেমন -পেট্রোলের পরিবর্তে -প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা।
-ধূমপান না করা,বিশেষ করে অন্য মানুষের কাছে বা বদ্ধস্থানে ধূমপান না করা।
-রান্নাঘরে বাতাস চলাচলের ভাল ব্যবস্থা তৈরি করা।
-বনভূমি সংরক্ষণ কর।
-উন্নত চুলা ব্যবহার করা।
-প্রচুর গাছ লাগিয়ে বনভূমি সৃষ্টি করা।
-যেখানে সেখানে কফ,থুথু,কাশি না ফেলা,মলমূত্র ত্যাগ না করা।
-ময়লা আবর্জনা, মৃত জীবজন্তু মাটিতে পুঁতে ফেলা।
-অহেতুক কোনো বস্তুকে জ্বালিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টি না করা।
-প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করা।
-বায়ুদূষণ করে এমন শিল্প কারখানা শহর থেকে দূরে স্থাপন করা।
-এ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

Similar Posts