মানুষের পরিচয় শনাক্তে হরেক রকম প্রযুক্তি- ১ম পর্ব
আমরা মানুষ হিসেবে যেমন সকলেই এক, একই রক্ত- মাংসের তৈরি, তেমনি ব্যক্তি হিসেবে সকলেরই কিছু আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে । আমরার প্রত্যেকেই দেখতে অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন, অন্যদের সাথে আমাদের অভ্যাসে, আচরণে, চেহারায় কিছুটা হলেও তফাৎ বা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । আবার, সৃষ্টিগতভাবেও আমাদের আঙ্গুলের ছাপ সহ আরও কিছু অনন্য বা ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে । এসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই আমাদেরকে শনাক্ত ও আলাদা করা হয় । এই বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা নির্দেশ করে। এসব বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ব্যক্তিকে শনাক্তের ক্ষেত্রে নানা ধরনের পদ্ধতি ও প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে । আজ আমরা এই প্রবন্ধে সেই প্রযুক্তি ও পদ্ধতি, সেগুলোর ব্যবহার ক্ষেত্র, সুবিধা- অসুবিধা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো ।
মানুষের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য সাধারণত দুই পদ্ধতিতে নিরূপণ করা হয় । একটি হলো আচরণগত পদ্ধতি বা Behavioral System , অন্যটি হলো শরীরবৃত্তীয় পদ্ধতি বা Physiological System । আচরণগত বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের মাঝে বহুদিন যাবত বিদ্যমান থাকে । তবে সময়ের সাথে সাথে কিংবা কোনো বিশেষ ঘটনার প্রভাবে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বদলে যেতে বা আংশিক পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে । কিন্তু, শরীরবৃত্তীয় বিষয়গুলো আমাদের মাঝে কম- বেশি বহুদিন যাবৎ স্থায়ী থাকে ।
বহু কাল আগে থেকেই আচরণের পার্থক্যের মাধ্যমে মানুষকে শনাক্ত করার বিষয়টি প্রচলিত রয়েছে । প্রাচীনকাল থেকেই তথা মানব জাতির সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ কণ্ঠস্বর শুনার মাধ্যমে এক জন অন্য জনকে আলাদা করতে পারে । কিন্তু, বিশেষ দক্ষতা বা চর্চার মাধ্যমে মানুষ একজন অন্য জনের কণ্ঠস্বর নকল করতে পারে । তাছাড়া দীর্ঘ সময়ের পার্থক্যে, কোনো দুর্ঘটনার কারণে, অসুস্থতাজনিত কারণে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে মানুষের কষ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, অনেকের বাক শক্তি না- ও থাকতে পারে । তথাপি অপরিচিত কোনো ব্যক্তি বা বহুকাল আগে সাক্ষাত হওয়া কোনো মানুষের শনাক্তের ক্ষেত্রে কণ্ঠস্বর খুব একটা ভালো উপায় নয় । তাই আরো ভালো মানের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।
মানুষ যখন লিখতে শুরু করে, তার অনেক পরে স্বাক্ষর দেয়ার প্রচলন শুরু হয় । বিশেষ অক্ষরশৈলী ব্যবহার করে মানুষ তার নিজের নাম লিখতে শুরু করে । ঠিক অনুরূপ অক্ষরশৈলী নকল করা বা অনুকরণ করা অন্য মানুষের পক্ষে কঠিন । তাই এমন অক্ষরশৈলী ব্যবহার করে নিজের নাম লিখা তথা স্বাক্ষর দেয়াকে মানুষের অন্যতম শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় । আজও বিভিন্ন কাজে- কর্মে, সরকারি অফিস- আদালত, ব্যাংক- বীমা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাক্ষরের প্রচলন রয়েছে । তবে বহু সময় ধরে নিখুঁতভাবে চর্চার মাধ্যমে এই স্বাক্ষর নকল করা তথা ব্যক্তির বিশেষ অক্ষরশৈলী অনুকরণ করা সম্ভব । বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কারো স্বাক্ষর জালিয়াতি করা কঠিন কিছু নয় এবং বর্তমানে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে । তবুও সোজা উপায়ে স্বাভাবিক ক্ষেত্রে শনাক্তের জন্য আজও এই পদ্ধতি চালু রয়েছে ।
কিবোর্ডে টাইপিং এর গতি যাচাইয়ের মাধ্যমেও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে শনাক্ত করা হয় । কি- বোর্ড কিংবা এই জাতীয় অনুরূপ কোনো ইনপুট ডিভাইসে ব্যক্তিকে তার গোপনীয় কোনো কোড বা লেখা টাইপ করতে দেয় হয় । ব্যক্তি কত দ্রুত তা টাইপ করে দিতে পারে, সেটা তার পূর্বের সময়ের সাথে মিলিয়ে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয় । এই আচরণগত বৈশিষ্ট্যটিও নকল করা সম্ভব । এই পদ্ধতিটি কেবল বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় । এই বিষয়ে ২০০৪ সালে এম. আই. টি’র গবেষকগণ একটি গবেষণা করেন । হাই সিকিউরিটি রিকগনিশনের ক্ষেত্রে ‘Layer by Layer’ ভেরিফিকেশানের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে ।
এতক্ষণ আমরা যেসব শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে জেনেছি, এগুলো সবই আচরণগত বৈশিষ্ট্য । আরো নিখুঁত উপায়ে ব্যক্তিকে শনাক্তের ক্ষেত্রে কিছু শরীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনা করা হয় । এই শরীরবৃত্তীয় শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে আমরা পরবর্তী পর্বে জানবো ।