আলো আঁধারের খেলা

ফোন হাতে নিয়েই চমকে উঠে মিলি। শিপনের নাম্বার থেকে ২৫ টি মিসড কল। শিপনতো জানে মিলি ক্লাস নেওয়াকালীন ফোন সাইলেন্ট মুডে রাখে। জানার সত্ত্বেও এত বার ফোন দেওয়ার কারণ কি! সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো? শিপনের কিছু হয়নিতো? মোবাইলের রিংটোনের শব্দে মিলির চিন্তায় ছেদ পড়ে।
-” হ্যালো, শিপন। তুমি ঠিক আছো তো? ”
-” মিলি, তোমাকে জলদি আমার হাসপাতালে আসতে হবে। ”
-” হাসপাতাল! হাসপাতাল কেন? ”
-“তোমার জীবন স্যার এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে। দেরি করোনা। ”


‘জীবন স্যার ‘ শব্দ দুটো কর্ণশ্রুত হওয়ার সাথে সাথে যেন মিলির সব শব্দ গুলো হারিয়ে গেছে, এক মুহূর্তের জন্য সবটা হয়ে গেছে অসাড়। নিজেকে কোন রকমে সামলে নিয়ে টেবিলে রাখা হ্যান্ড ব্যাগটা তুলে নিয়ে পা বাড়ায় দরজার দিকে।
– ” মিতা দি, হেড স্যারকে বলে দিও আমার পরের ক্লাস দুটো যেন অন্য কেউ নেয়। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। ” যে মানুষটি নিজের শত দরকারি কাজ, শরীর খারাপকে উপেক্ষা করে নিজের পেশাকে সবার উপরে রেখেছে, সে মানুষটি এমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়া মনের মধ্যে বড় একটি বিষ্ময় চিহ্নের আগমন ঘটায়। মিতা দি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু মিলির আজ কিছু শোনার সময় নেই। কানের কাছে বারংবার দুটো শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে ” জীবন স্যার। ”

গাড়ির জানালার কাঁচ ভেদ করা বাইরের দৃশ্য গুলো আজ বড় ঝাপসা ঠেকছে মিলির কাছে। চোখের সামনে রঙিন হয়ে ধরা দিচ্ছে দশ বছর আগেকার তেলো চুলে বিরুনি কাটা মিলির মুখটা।

যে বয়সে মনের আকাশে উড়ে বেড়ায় নানান রঙের ফানুস, সে বয়সে দারিদ্রতা মিলিকে শিখিয়েছে জীবনের কঠিন বাস্তবতা। পরিবার বলতে বাবা আর মিলি। জ্ঞান হওয়ার আগেই মা পাড়ি জমিয়েছে অজানা দেশে। বাবার আর আগের মতো রিক্সা টানার জোর ছিলনা। তাই মিলি বাবার হাজার বারণ অগাহ্য করে নেমে পড়ে অন্যের ঘরের বাসন মাজার কাজে। তাতে যদি বাবার একটু আর্থিক ভাবে সাহায্য হয়। এইভাবে চলছিলো তার পড়াশুনো।

ক্লাসে ঢোকার পর মিলি দেখে আজ তার সহপাঠীরা অন্যদিনের মত খুনসুটিতে মজে নেই। সবাই গুরুগম্ভীর মুখে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। রিক্সাচালকের মেয়ে বলে কেউ মিলির পাশে দায়ে না পড়লে বসতে চায়না। নোটের আশায় উপরি উপরি ভাবটা রাখে। সেটি মিলিরও অজানা নয়। অন্যের কাছ থেকে বই ধার করে মিলির তৈরি করা নোট যেন ক্লাসের সবার কাছে “পাবলিক প্রপার্টি “। গরীবের যে “না” শব্দটি বলতে নেই।
-“শুনেছিস, স্কুলে এক নতুন ইংরেজীর স্যার এসেছেন। ভীষণ কড়া মেজাজের। কাল দেখলাম ক্লাস সেভেনের কয়েকটি ছেলে মেয়েকে মাঠের মাঝখানের দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম হোম-ওয়ার্ক আর বই ছাড়া ক্লাসে আসার শাস্তি। ”
-” কি বলছিস! এখন আবার হোমওয়ার্ক করতে হবে? তারওপর আবার বইয়ের বোঝা! আগের মাষ্টার মশাই কত ভালো ছিলো। গল্প করে ক্লাস টাইম কাটিয়ে দেওয়া যেত। ”
নতুন স্যারের ব্যাপারে আলোচনায় সবাই এতটাই মশগুল আছে যে সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পরা একজন তাদের
পেছন দিকে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ তাদের গল্প শুনছে সেটি আর কারোর মনোযোগে নেই।

-” যদি আলোচনা সভা শেষ হয়ে থাকে তবে আমারা ক্লাস শুরু করতে পারি কি? আশা করছি পরিচয়টা সকলে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছ। আর একটা কথা , বইয়ের বোঝা বইতে না পারলে বিদ্যার বোঝা কি করে বইবে? ”

মিলি প্রতিটি কথা খুব মন দিয়ে শুনছে। কিন্তু বই যে তার ব্যাগে আসতে চায় না। কারণ কড়কড়া সাদা নোট যে তার কাছে নেই।
” তোমার বই কোথায়?
” মিলির কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। কাল থেকে যেন বই ছাড়া না দেখি। পর পর তিন দিন মিলির জায়গা হল মাঠের মাঝখানে। যে মেয়ে নোটস এতো যত্নের সাথে করতে পারে তার বইয়ের প্রতি অনীহা কেন? প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে মিলির ডাক পড়ে টিচার্স রুমে।
-” বইয়ের সাথে শত্রুতার কারণ কি? ”
-স্যার, বন্ধুত্ব হয়নি কখনো। কিছু সময়ের জন্য কাছে থাকে তারপর আবার ফিরে যায় তার মালিকের কাছে।”
জীবন স্যার দেখতে পায়, কথাগুলো বলার সময় নিরব কষ্টেরা মিলির চোখে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
-“এই বইটা রাখো।”
-” কবে ফেরত দিতে হবে স্যার? ”
-” ফেরত দিতে হবেনা। ”
-” ক্ষমা করবেন স্যার। তাহলে বইটি আমি নিতে পারব না। ”
-“থাকো কোথায়? ”
-” স্কুলের পাশের পাড়াতে। ”
-” বাড়িতে কে কে আছে। ”
-” বাবা আর আমি। ”
-” বেশতো। আমিও ঐ পাড়াতেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। এই বুড়ো মানুষটার জন্য দুটো ডাল -ভাত রেঁধে দিয়ো। আর বুড়োটা তোমায় একটু আধটু ইংরেজীটা পড়িয়ে দেবে। ”
জীবন স্যারের মিষ্টি হাসিটা আজো মিলির চোখে অমলিন।
-” কি হল? গাড়ি থামালে কেন?
-” সামনে মনে হয় একটু ঝামেলা হচ্ছে। আমি দেখে আসছি। ”
মিলি আজ কিছুতেই অতীত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছেনা। বেশ ভালোই কাটছিলো দিনগুলো।প্রিয় শিক্ষকের সংগ মিলির কাছে খুব পরিষ্কার আর জীবন স্যার ও বুঝতে পেরেছে সব ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষকদের কাছে একই হয়না। কারো কারো প্রতি স্নেহটা একটু বেশি থাকে।

-” তোমার একটা বিচার আছে। ”
-” আমি কি করেছি স্যার? ”
-” তুমি তোমার নোটস গুলো ক্লাসের সবাইকে দিয়ে তাদের ক্ষতি করছো। তুমিই যদি সবটা করে দাও তবে তারা শিখবে কি? ”
-” এমনটা আর হবেনা স্যার। ”
মিলি ক্লাস শুরুর আগে সেদিনকার পড়াগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। আর ঠিক সেই সময় রতন অনেকটা হুকুমের সুরে মিলির নোটস গুলো দিতে হবে। স্কুল কমিটির প্রধানের ছেলে বলে অহংকারের মাত্রাটা বড্ড বেশি। মিলি দিতে বারণ করলে অকথ্য ভাষার তীর ছুটে আসে তার দিকে।
-“কেন দিবিনা। তোর রসের নাগর জীবন স্যার দিতে বারণ করেছে বুঝি? ”

চড়ের সপাট শব্দ পুরো ক্লাসকে যেন মুহূর্তের মধ্যে নিরবতার চাদরে গ্রাস করে নিয়েছে।
-“আমার আজ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে। তোমার মতো অভদ্র ছেলে যার ছাত্র যার ছাত্র তার শিক্ষকতা জীবন বৃথা। ”

তারপর ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে গেছে অনেক গুলো দিন।
-” শুভ জন্মদিন স্যার। ”
-” ভুলে গেছিলাম। বুড়ো হয়ে গেছি রে। আজ ব্যাগটাও স্কুলে ফেলে এলাম।”
-” আপনার জন্মদিন মনে করিয়ে দিলাম আর আমি কিছু পাবনা?
-” কি চাই বলো”
-” আপনার ছবিটা আমার বাবার ছবির পাশে দেয়ালে টাঙ্গাতে চাই। দেবেন না স্যার।? ”
-” সাবধানে নিয়ে যেও। ”

রতনের চোখে মুখে মিলির প্রতি এক ভয়ানক ঘৃণা দেখতে পায় মিলি। কখনো জল ফেলে বই ভিজিয়ে দেয়, কখন ইচ্ছে করে সব মাটিতে ফেলে দেয়। জীবন স্যার ক্লাস নিচ্ছে আর সেই সময় হেড স্যার সাথে আরো কয়েকজন স্যার ক্লাসে হাজির। সাথে আছে রতনের বাবা।
-” জীবন বাবু, আপনার নামে পরিচালনা কমিটি নালিশ করেছে। আপনি নাকি আজেবাজে ম্যাগাজিন ছাত্রদের পড়তে উৎসাহিত করেন। আবার তা তাদের মাঝে বিলিয়ে দেন। আপনার ব্যাগ টিচার্স রুম থেকে নিয়ে এসেছি। চেক করার জন্য। মিলির ব্যাগটাও চেক করতে হবে ”

জীবন স্যারের মুখ কথা সরছেনা। ব্যাগ থেকে যা পাওয়া গেল তা বিশ্বাস করার মত নয়। পুরোটা রতনের সাজানো। স্যার ব্যাগ ফেলে গেছে আর রতন সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে। আর মিলিকে ব্যাস্ত রাখার জন্য রতন বই মাটিতে ফেলে দিয়েছিলো। আর সেই সুযোগে ব্যাগে এসব পুরে দিয়েছে। সে থেকে জীবন স্যারের মিষ্টি হাসিটা মিলির চোখে আর ধরা দেয়নি।

বাড়ি গিয়ে দেখেছে মস্ত বড় তালা ঝুলছে দরজার সামনে। সময় বয়ে গেছে তার নিয়মে। পড়াশুনোর গন্ডি ফিরিয়ে মিলি আজ একজন শিক্ষক। জীবন স্যার তার পথ চলার আদর্শ । জীবন স্যারের কথা গুলো আজো মিলির কানে বাজে। ” জীবনে কখনো নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেবেনা। নিজের চোখে যদি নিজে ছোট হয়ে যাও তবে কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবেনা। আর অন্যায়কে প্রশয় দেওয়া মানে নিজ হাতে নিজের বিবেককে পঙ্গু করে দেওয়া।

শিপনের ফোনে মিলির চিন্তায় ছেদ পড়ে -“আর কতক্ষণ? ”
-” অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব। ”
শিপনের সাথে প্রথম দেখা স্কুলের পেরেন্টস ডে তে। পুরো প্রোগ্রামের ভার পড়েছিলো মিলির ওপর। স্কুলের অডিটোরিয়ামের, সামনে পায়চারি করছিলো মিলি। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।
-” এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে আপনার?, আপনাদের পেরেন্টসদের যদি সময় জ্ঞান না থাকে তবে বাচ্চাদের আর কি শেখাবেন! অডিটোরিয়ামের ভেতর গিয়ে বসুন। প্রোগ্রাম একটু পর শুরু হবে।”
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিলি তার সমস্ত রাগ বর্ষণ করে নিয়েছে এ আগুন্তকের উপর।
হঠাৎ তার কলিগ মিতা দির গলার আওয়াজটা শুনতে পায় মিলি।
-” ভাই, তুই এসেছিস? ফাইলটা দে। বুঝেছিস মিলি, ফাইলটা ফেলে এসেছিলাম। ভাই হসপিটাল থেকে বাড়ি গিয়ে নিয়ে এলো। আমার ভাই শিপন,ডাক্তার। আর এ হচ্ছে আমার কলিগ মিলি। ”
-” পরিচয় পর্বের কিছুটা সারা হয়ে গেছে দিদি। আসি তবে। ”
মিলি ভুল দেখছেনা তো! রাগের বদলে ঐ চোখ দুটোতে দেখা যাচ্ছে অজানা এক স্নিগ্ধতা।

বাবাকে নিয়ে বিকেলে পার্কে বেড়িয়ে আসাটা মিলির ব্যাস্ততার মাঝে কিছুটা অবসর। পার্কের এক কোণায় গোলাকার ভাবে বসে আছে কয়েকটি বাচ্চা যাদের আমরা সবাই পথশিশু বলেই আখ্যায়তি করে থাকে। আজ আর মিলির ভুল হচ্ছেনা। তাদের সামনে সেদিনকার ব্যাচেলর “বাবা “।
-” ডাক্তার মশাই দেখছি মাষ্টার মশাইয়ের কাজটাও করে। ”
-” সপ্তাহে একদিন আমার এই ক্ষুদে বন্ধুদের নামে তুলে রাখা থাকে। আর আসতে কিন্তু দেরি হয়না। বলা তো যায় না। কে আবার কখন বকাঝকা শুরু করে। ”
-” এই ক্ষুদে বন্ধুদের তালিকায় বড় বন্ধুটির নাম কি যোগ করা যায়? ”
সেই দুজনার পথচলা শুরু। সম্পর্কটা বন্ধুত্বের গন্ডি ছাড়িয়ে নিয়েছে অন্য নাম। বিয়ের আগে শিপন মিলিকে বলেছিল,”তোমার বাড়ি থেকে শুধু তুমি আর তোমার বাবা আসবে। আর কিছু নয়।
– ” তা শুনে মিলি বলেছিল, “সাথে ঐ ছবিটাও আসবে। ”
-” কে উনি। ”
-” জীবন স্যার। ”

গাড়ি থেকে নেমে মিলি ছুটে চলেছে শিপনের চেম্বারের দিকে। চেম্বারের সামনে গিয়ে বেডে শুয়ে থাকা লোকটিকে দেখে মিলির আর পা চলছেনা।তার সেই চিরচেনা মুখ। যাকে মিলি এতদিন খুঁজছিল। তার চেয়েও বেশি চমকে উঠে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটোকে দেখে। রতন আর তার বাবা।
-“মিলি তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? এই ভদ্রলোকের ছেলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। হঠাৎ দৌড়ে রাস্তার মাঝখানে বাইকের সামনে এসে পড়ে। ভাগ্যিস তোমার জীবন স্যার জলদি এসে সরিয়ে নিয়েছিলো। তবে স্যারের সামান্য লেগেছে। ঘুমের ঔষুধ দিয়ে দিয়েছি।”

মিলির চোখ আটকে আছে রতনের দিকে।
-” চার বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে এই অবস্থা হয়েছে। এখন শুধু গুনগুন করে একটা কথায় বলে সারাক্ষণ। স্যার ক্ষমা করে দিন আমায়। পারলে ক্ষমা করে দিও আমাদের ”
-“ক্ষমা আমার কাছে না, ঐ শুয়ে থাকা মানুষটির কাছ থেকে চেয়ে নিন।”
বলেই জলদি বেরিয়ে আসে চেম্বার থেকে না, মিলি পারবেনা জীবন স্যারের সামনে দাঁড়াতে।

পহেলা বৈশাখ । মিলি আর মিতা দি রান্নাঘরের কাজে ব্যাস্ত। হঠাৎ শিপন এসে মিলির চোখ দুটো হাত দিয়ে ঢেকে দেয়।
-” আহা, করছো কি? ”
-” তোমার জন্য পহেলা বৈশাখের উপহার এনেছি। দেখবে চলো।”
চোখ থেকে শিপন হাত সরিয়ে নিলে মিলি কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। কাকে দেখছে মিলি তার সামনে। জীবন স্যার!
-” সেদিন আমি চলে না আসলে তুমি হয়তো নিজেকে গুটিয়ে নিতো।তোমার ভেতরের জেদটাকে জাগানোর জন্যই আমি সেদিন সরে এসেছিলাম।এই বুড়োটার ওপর অভিমান রেখো না। ”

কখনো কখনো চোখের জলেরাও দারুন প্রশান্তি বয়ে আনে। আজ তাদের মিলি আটকাবেনা। তারা আপন মনে ঝরুক। এমন পহেলা বৈশাখ যেন মিলির জীবনে বারবার আসে।

Similar Posts

One Comment

Comments are closed.