বই, বই এবং বই (২) – একজন ডলি পার্টন

শীতের শুরুতে আর বসন্তে স্টোরিটাইমের পাশাপাশি লাইব্রেরি আলাদা করে ফ্যামিলি স্টোরিটাইমের আয়োজন করতো যেখানে শিশুদের সাথে তাদের মা বাবাকেও আমন্ত্রণ জানানো হত। বন্ধুদের সাথে বসে গল্প শোনাটা বেশ মজার কিন্তু সাথে যদি মা আর বাবা দুইজনেই থাকে, তাহলে সেই আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। দেড়মাস ধরে সান্ধ্যকালীন চলতে থাকা এই “ফ্যামিলি স্টোরিটাইম” লাইব্রেরিতে আসা বাচ্চাদের কাছে একটা আলাদা আকর্ষণ। এগুলো প্রোগ্রাম করার উদ্দেশ্যই ছিল বইয়ের প্রতি শিশুদের আগ্রহ এবং ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলা। খুব ছোট্ট বয়স থেকে গড়ে ওঠা এই সুন্দর অভ্যাস সারাজীবন থেকে যায়। আর এভাবেই লাইব্রেরি হয়ে উঠেছিল আমাদের খুব ভালোবাসার একটা জায়গা।

life-in-america-american-public-library-part-2

এসবই ছিল প্যানডেমিক হওয়ার আগের ঘটনা। আমাদের শহর লকডাউন হয়ে যাবার আগে ভেবেছিলাম লাইব্রেরি থেকে বেশ কিছু বই নিয়ে আসব। কিন্তু সে সুযোগ আর পাওয়া যায়নি। হঠাৎ লাইব্রেরি ইমেইল দিয়ে জানিয়ে দেয় যে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে যে বইগুলো থেকে যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে চিন্তার কারণ নেই, লাইব্রেরি খোলার পরে ফেরত দিলেই হবে। গৃহবন্দী অস্থির সেই সময়গুলোতে প্রথমবারের মতো বুঝেছিলাম লাইব্রেরি আমাদের জীবনে কতোখানি জায়গা জুড়ে ছিল। একই বই বারবার পড়ার একঘেয়েমির মতই দিনগুলোও খুব স্থবির ছিল। আমাদের কোথাও যাওয়ার ছিল না। লাইব্রেরি কেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, সেটা আমার মেয়েকে বোঝানো কঠিন ছিল। সে প্রায়দিনই জিজ্ঞেস করতো আমরা কখন লাইব্রেরিতে যাব?

প্রায় দেড়মাস বন্ধ থাকার পর লাইব্রেরি খুলে যায়। তবে কোনকিছুই আর আগের মতো নেই। লাইব্রেরি এখন সীমিত সময়ের জন্য খোলা থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট সময়ে সীমিত সংখ্যক মানুষ সেখানে ঢুকতে পারে। ধীরে ধীরে স্টোরিটাইমও চালু করা হয় তবে সেটা ভার্চুয়ালি। সামনাসামনি সবাইকে দেখতে পারার যে আনন্দ, কম্পিউটার স্ক্রিনে তা অনেকটাই কমে যায়। লাইব্রেরিতে আমাদের যাতায়াতও আগের চেয়ে কমে এসেছে। এবারের শীতের দীর্ঘ রাতগুলো অন্যান্যবারের চেয়ে ভিন্ন হবে; লাইব্রেরি হয়তো আগের মতো আর দীর্ঘ সময়ের জন্য খোলা থাকবে না।

 

স্টোরিটাইম
বুকশপ বারনেস এন্ড নোবল্
ইউনিভার্সিটির ভেতরের প্যারেন্ট রিসোর্স লাইব্রেরি

 

একজন ডলি পার্টন এবং তার ইমাজিনেশন লাইব্রেরি

লাইব্রেরিতে যেতে যেতে এমন আরো কিছু বই পড়ার প্রোগ্রামের সাথে আমরা যুক্ত হয়েছিলাম। তারই একটা হচ্ছে আমেরিকার বিখ্যাত গায়িকা ডলি পার্টনের সৃষ্টি “ইমাজিনেশন লাইব্রেরি” (Imagination Library)। ডলি পার্টন একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার, গায়িকা, লেখিকা, অভিনেত্রী এবং সফল ব্যবসায়ী। তার দারিদ্র্য জর্জরিত শিশুকাল কেটেছে টেনেসি অঙ্গরাজ্যের স্মোকি মাউন্টেনের পাহাড়ঘেরা উপত্যকায়। ডলির বাবা রবার্ট লী পার্টন পড়তে জানতেন না যেটার আক্ষেপ তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। নিজের জন্মস্থানের জন্য ডলি সবসময় কিছু করতে চাইতেন। তার প্রতিষ্ঠিত ডলিউড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে টেনেসির সেভিয়ার কাউন্টিতে প্রথম ইমাজিনেশন লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয় যেটায় শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুকে মাসে একটা করে বই উপহার দেয়া হতো। বই পড়ার প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ইমাজিনেশন লাইব্রেরি এতো বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায় যে টেনেসির ছোট্ট সেভিয়ার কাউন্টি ছাড়িয়ে পুরো আমেরিকাতে তা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এর সাথে যুক্ত হয়। আর তারপরে আমেরিকার সীমা ছাড়িয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের শিশুরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ডলি পার্টন শিশুদের কাছে “বুক লেডি” নামে পরিচিত। এই প্যানডেমিকের মাঝে যখন লাইব্রেরি, বুকশপ সব বন্ধ ছিল তখনো  ইমাজিনেশন  লাইব্রেরির বই আসা থেমে থাকেনি। মানুষের কীর্তি মাঝেমাঝে তার জীবনকেও ছাড়িয়ে যায়; ডলি পার্টনের ইমাজিনেশন লাইব্রেরি তেমনই এক কীর্তি। এখনো তিনি প্রতিনিয়ত নতুন গান এবং শিশুদের জন্য বই লিখে চলেছেন।

প্রতি মাসে চিঠির বাক্স খুলে যখন নতুন বইটা মেয়ের হাতে দিই, তখন তার মুখে যে চওড়া হাসি আর চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যায়, সেটা আমাকেও গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা সারাজীবন অটুট থাকুক।

Similar Posts