করোনা ভাইরাসের আত্মকথা
আমি একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস। আমার ভালো নাম নোভেল করোনা। আমার আকার দেখতে অনেকটা ছোট-বাচ্চাদের খেলনা পিংপং বলের মতো।
ওহো! বলতে ভুলে গেছিলাম যে আমার একটি বিশেষ দিক আছে। আমি খুব সহজেই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের কাছে ছড়াতে পারি। এইক্ষেত্রে আমি আবার সাম্যবাদী মনোভাবে বিশ্বাসী। দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে আমার বেশ ভালোই লাগে।
আমার পূর্ব পুরুষদের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৩০ সালের দিকে।
মাঝে আমাদের বংশের আদিপত্য কমে গেলেও আমার হাত ধরে আবার তা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। আমার জন্ম ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে। জন্মের পর আমার নাম রাখা হয় ‘২০১৯- এনসিওভি’।
তো এবার আসি আমার চলাফেরা নিয়ে। উহানের এক বাজারে আমি প্রথম এক মানুষের দেহে প্রবেশ করি।
এরপর আস্তে আস্তে আমি আমার বংশবিস্তার করতে থাকি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পুরো উহান শহরে আমার আধিপত্য বিস্তার করে ফেলি।
মানবজাতি কিছু বুঝে উঠার আগেই চীনের অন্য সব প্রদেশেও আমি পৌঁছে যাই।
ও হ্যাঁ, একটা কথা তো বলাই হয়নি, আমি অবস্থান করছি এমন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির তিন ফুটের মধ্যে যদি অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে পাই, সুযোগ বুঝে অমনি তার কাছে চলে যাওয়ার চেষ্টা করি ।
আমার প্রথম সাফল্য আসে এ বছরের ১১ জানুয়ারি।
প্রথম কোনো মানুষের মৃত্যুর কারণ হই আমি। সেদিন থেকে আমি বেশ উৎসাহের সাথে কাজ করা শুরু করি। আস্তে আস্তে চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ি।
এক দেড় মাসের মধ্যেই পুরো বিশ্ব আমার নাম জেনে যায়। তখন নিজের আদিপত্য বিস্তার করার জন্য সাম্রাজ্য দখলে বের হই।
প্রথম লক্ষ্য হিসেবে ইরানে নিজের প্রভাব ভালোই ছড়াতে থাকি।
তাছাড়া আশেপাশের দেশগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করতে থাকি। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাকে বিশ্ব মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
নিজের এরূপ স্বীকৃতি দেখে গর্বে আমার বুকটা ফুলে যাচ্ছিল। পুরো বিশ্ব এখন আমাকে চেনে। আমার জন্য আতঙ্কিত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, পেরু , যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে আমার জন্মভূমি চীন কেউই আমাকে প্রতিহত করতে পারছে না।
পুরো বিশ্বে আমি আমার সাম্রাজ্য গড়ে নিয়েছি। আমার আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দেশের সরকার লকডাউন এর ব্যবস্থাও করেছে।
শত চেষ্টা করেও কেউ আমাকে দমাতে পারছে না। বিভিন্ন দেশে দেখলাম আমাকে প্রতিহত করার জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে।
কিন্তু বিধি বাম। কেউই আমাকে দমাতে পারছে না। তাই আমার সাম্রাজ্য দখলে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারছে না।
সাম্রাজ্য দখল করতে যেয়ে আমি অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। মানুষের বিচিত্র রকম আয়োজন দেখে আমার মজাই লেগেছে।
প্রায় দুইশর বেশি দেশ ঘুরে আমি সবচেয়ে বেশি বিনোদন পেয়েছি বাংলাদেশে।
দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটা দেশ। আয়তনে ছোট হলে কী হবে, এত বেশি মানুষ যে কি আর বলব। তো আমি ঐ দেশে প্রথম যাই মার্চের ৮ তারিখ। ওরে বাবা, আমি উপস্থিত হতেই সে কী তুমুল কাণ্ড।
ঐ দেশে মানুষ এতটাই গর্ধব যে, প্রধানমন্ত্রী বলে লকডাউনের কথা আর এদিকে একদল লোক আন্দোলন শুরু করে যে মরলে নাকি এমনিই মরবে। আমি নাকি ওদের কিচ্ছু করতে পারব না।
এই কথা শোনার পর মেজাজটা এতো গরম হইল যে, ঠিক করে নিলাম যে এই দেশ থেকে আমি আর যাবোই না।
আরেকটা কথা মনে পড়ল, একদিন আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি।
হঠাৎ দেখি এক লোক রাস্তার উপর কী সব বিক্রি করছে। পাশে পোস্টারে বড় করে লেখা- ‘করোনা প্রতিরোধী তেল।’ আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। বাঙালি এতো বোকা কেন?
আরেকটা মজার কথা বলি – হঠাৎ একদিন দেখলাম ফেসবুকে একটা খবর রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেছে।
খবরটা হলো এই যে- কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেউ একজন নাকি ঢ্যাঁড়শ না কি একটা সবজি খেয়ে আমার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।
এসব দেখে এই জাতির জন্য আমার নিজেরই কষ্ট হয়।
এই দেশে যে কত মজার মজার ঘটনা দেখেছি, কী আর বলব।
আমার হাত থেকে বাঁচতে দেশে সরকার সাধারণ ছুটি দিয়েছে। তো এই ছুটিতে গরিব মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে কোটি কোটি টাকা সরকার বিনিয়োগ করছে।
আর সেই টাকা দিয়ে কেনা তেল-চালের বিশাল ভাণ্ডার কিছু মানুষের খাটের নিচ থেকে পুলিশ উদ্ধার করছে। বড় বিচিত্র জাতি এরা।
দুইশর বেশি দেশ ঘুরে কিছু মানুষকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। রাত দিন নিজেদের বিসর্জন দিয়ে তারা মানুষের সেবা করে যাচ্ছে।
আমাকে ভয় না করে আমি যাদের আক্রান্ত করেছি, তাদের সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে।
দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের পর যখন কেউ একজন আমার হাত থেকে মুক্তি পায়, তখন সেই সেবাদানকারীর মুখের চওড়া হাসি দেখতে সত্যিই ভাল্লাগে।
কিন্তু এদের মধ্যেও অল্প কিছু খারাপ আছে, যারা রোগীর রিপোর্ট নিয়েও ছিনিমিনি খেলেছে। টাকার বিনিময়ে ভুয়া রিপোর্ট দিচ্ছে। এরা অধম।
এতসব ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে।
একটা ঘটনা বলি- একদিন আমি এক বৃদ্ধার শরীরে আক্রমণ করে বসি। আমাকে কাবু করার ক্ষমতা না থাকায় সে খুব তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে পরিবারের লোকজন ঐ বৃদ্ধাকে হাসপাতালে নিতে বাধ্য হয়।
হাসপাতালে নেওয়ার পথে বৃদ্ধার এত বেশি শ্বাসকষ্ট শুরু হয় যে বৃদ্ধার নাতি আমার ভয়কে উপেক্ষা করে ঐ বৃদ্ধাকে মুখ দিয়ে শ্বাস দেওয়া শুরু করে।
ঘটনাটা আমার কাছে খুব হৃদয়বিদারক ছিল। বারবার ভাবছিলাম মানুষ যদি নিয়ম মেনে চলে তাহলেই তো আমার হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পেতে পারে।
আমার ছোটখাটো একটা লক্ষ্য ছিল যে দীর্ঘদিন ধরে এই পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পারব।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খুব বেশিদিন আর আমি আমার আধিপত্য বিস্তার করতে পারব না। এরা যেভাবে আমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে!
আমি হয়তো একদিন চলে যাবো।
কিন্তু আশা রাখি, এই পৃথিবী তখন স্বাভাবিক হবে, নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
সচেতনতা আর নিয়মনীতি মেনে সুস্থ, সুন্দর, সবুজ এক পৃথিবী গড়ে তুলবে।