ওয়াকিটকি ও মোবাইল ফোন: ওয়াকিটকি বিলুপ্ত হলোনা কেন!!!
বর্তমানে তথ্য আদান-প্রদান দিন দিন সহজ, উন্নত ও দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য পাঠাতে মাত্র মিলিসেকেন্ড পরিমাণ সময়ই যথেষ্ট। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নানা ক্ষেত্রে আধুনিকায়ন করা হলেও সুবিধা-অসুবিধার তুলনায় বিভিন্ন প্রাচীন যন্ত্রের ব্যবহার আজও প্রচলিত রয়েছে। তেমনি একটি প্রাচীন যন্ত্র হলো ওয়াকিটকি। আপনারা প্রায়ই পুলিশ বাহিনী, সেনা বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থা ও জন নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন কাজে ওয়াকিটকির ব্যবহার দেখে থাকবেন। মোবাইল ফোন এমনকি আরও আধুনিক অনেক প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও ওয়াকিটকি আজও কিভাবে টিকে রয়েছে, সে চিন্তা আপনাদের অনেকের মনে আসতে পারে। ওয়াকিটকি ও অন্যান্য প্রযুক্তির কার্যকৌশল বুঝতে পারলে এর উত্তর সহজেই বোধগম্য হবে।
ওয়াকিটকির ইতিহাস ও কার্যকৌশল:
১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত সময়ে মটোরোলা কোম্পানির টিম এবং ডোনাল্ড হিংগস্ ও আলফ্রেড গ্রস এর যৌথ প্রচেষ্টায় ওয়াকিটকির যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। আমেরিকান সেনা বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ওয়াকিটকির ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে ওয়াকিটকির ব্যবহার আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ওয়াকিটকি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে হাফ-ডুপ্লেক্স মোডে তথ্য আদান-প্রদান করে। হাফ-ডুপ্লেক্স মোডের কোনো ডিভাইসে একইসময়ে ডাটা আদান ও প্রদান করা যায়না, আলাদা আলাদা সময়ে করতে হয়। তাই ওয়াকিটকিতে যখন ডাটা রিসিভ হয়, তখন ডাটা সেন্ড করা যায়না। আবার যখন ডাটা সেন্ড হয়, তখন ডাটা রিসিভ করা যায়না। সাধারণত ডাটা রিসিভিং মোডেই থাকে। যখন দরকার তখন PTT (Push To Talk) বাটন চেপে ধরে কথা বলা যায় বা ডাটা সেন্ড করা যায়।
সাধারণত প্রতিটি পুলিশ স্টেশনেই ওয়াকিটকির টাওয়ার বা রেঞ্জ এমপ্লিফায়ার থাকে। ওয়াকিটকির রেঞ্জ সাধারণত ৫ কিলোমিটার। এই রেঞ্জের মধ্যে বিশেষ কম্পাঙ্কের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অনেক গুণে এমপ্লিফাই বা বর্ধিত করে বায়ু বা শূন্য মাধ্যমে বিচ্ছুরণ করা হয়। রেঞ্জের মধ্যে থাকা কানেক্টেড ওয়াকিটকি ডিভাইসগুলো উক্ত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভ করে নেয়। ফলে ডাটা আদান কিংবা প্রদান করা সম্ভব হয়। পুলিশ বাহিনীতে সাধারণত রেঞ্জগুলো ভাগ করা থাকে এবং কন্ট্রোল রুম থেকে বিভিন্ন রেঞ্জের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
মোবাইলের কার্যকৌশল:
মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে প্রথমে একটি মোবাইল থেকে সংশ্লিষ্ট সিম কোম্পানির টাওয়ারে সিগনাল যায়, সেখান থেকে আরও একটি কেন্দ্রীয় টাওয়ারে সিগনাল যায়। তারপর আবার প্রাপক মোবাইল ফোনের টাওয়ারকে খুঁজে নেয়। প্রাপক মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে প্রাপকের মোবাইলে সিগনাল আসে। তারপর ডাটা আদান-প্রদান সম্ভব হয়। ফুল-ডুপ্লেক্স মোডের ডিভাইস হওয়াতে মোবাইল ফোনে তথ্য আদান ও প্রদান একই সাথে করা সম্ভব হয়। মোবাইল ছাড়া অন্যান্য আধুনিক মাধ্যমে ডাটা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রেরক ও প্রাপক উভয়কেই একই সময়ে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয়।
ওয়াকিটকি কেন টিকে রইলো:
আধুনিক মোবাইল ফোন ও অন্যান্য প্রযুক্তির তুলনায় ওয়াকিটকি অনেকটাই প্রাচীন যন্ত্র। তবে বেশ কিছু সুবিধা বিবেচনায় ওয়াকিটকি আজও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচলিত রয়েছে। মোবাইল ফোন বা অনুরূপ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রেরক কর্তৃক প্রাপককে খুঁজে নিতে হয়। দেশের কোটি কোটি জনগণের মোবাইল সিগনালের ভিড়ে কাংখিত প্রাপককে খুঁজে নিতে বেশ বড় একটা সময় (হোক তা ৫-১০ সেকেন্ড) অপচয় হয়। অন্যদিকে, ওয়াকিটকি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনী থানা বা সার্কেল ভিত্তিক রেঞ্জ তৈরি করে রাখে। এই রেঞ্জের সকল ওয়াকিটকি একই সময়ে কানেক্টেড থাকে। ফলে ডাটা আদান বা প্রদান করতে সময় অপচয় হয়না।
কোটি কোটি মোবাইল সিগনাল সামলাতে অপারেটর কোম্পানিগুলোকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। তাই বিভিন্ন জায়গায় সিগনাল কম-বেশি হয়, মাঝেমাঝে সিগনাল একেবারেই কমে যায়। ফলে তথ্য আদান-প্রদানে বিঘ্ন ঘটে। সব স্থানে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়া যায় না। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে জরুরী সময়ে নিরবছিন্ন তথ্য আদান-প্রদান বিঘ্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু, ওয়াকিটকির ক্ষেত্রে রেঞ্জভিত্তিক অল্পকিছু ডিভাইস কানেক্টেড থাকে। প্রতিটা থানাতেই টাওয়ার/অ্যামপ্লিফায়ার থাকে। তাই দ্রুততার সাথে নিরবছিন্ন তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব হয়।
অর্থাৎ, যতই আধুনিক প্রযুক্তি হোক তাতে জরুরী সময়ে নিরবছিন্ন ডাটা আদান-প্রদান বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রাচীন ডিভাইস হওয়া সত্ত্বেও ওয়াকিটকির প্রচলন আজও রয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে ওয়াকিটকির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিটিআরসি কর্তৃক আইন জারি করা হয়। এই আইনের অধীনে যেকোনো প্রকার ওয়াকিটকি ব্যবহারে লাইসেন্স নেওয়া আবশ্যক। তাই ব্যাক্তিগত বা কোম্পানির কাজে ওয়াকি টকি ব্যাবহার করতে চাইলে অবশ্যই লাইসেন্স করে নিবেন এবং এ সংক্রান্ত সরকারী অন্যান্য নির্দেশনাবলী ভালো মতো জেনে নিবেন।