বিশ্বের বিস্ময়, আমাদের গর্ব- ঢাকাই মসলিন (২য় পর্ব)
(গত পর্বের পরে …)
একসময় ঢাকাই মসলিন এর সোনালী সময় ছিলো। ঢাকা আর সোনারগাঁও অঞ্চলের তালিকাবদ্ধ তাঁতিদের হাতে তৈরি করা হতো মসলিন। মোগল তাঁতখানায় ঢাকার সবচেয়ে দক্ষ তাঁতিদের নিয়োগ দেয়া হতো। তবে তাঁতিদেরকে মোগল তাঁতখানায় খুবই কম মজুরি দেয়া হতো। নিযুক্ত হওয়ার পর তাঁদেরকে বাইরে কাজ করবার অধিকার দেয়া হতো না।
মসলিন তৈরিতে খুবই পরিশ্রমের প্রয়োজন। দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করার পর তাঁতিরা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম মজুরি পেতো। মোঘল কর্মচারীদের অনেকেই তাঁতিদের মজুরীতে কারচুপি করতো, লুটপাট করতো। মসলিন যখন মোগল দরবারে পৌঁছতো, তখন প্রায়ই খুশি হয়ে পুরষ্কার দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতো। কিন্তু, সেই পুরস্কারের কিঞ্চিত অংশও তাঁতিরা পেতোনা। রাজ কর্মচারীরাই তা লুটেপুটে খেয়ে ফেলতো। কাজের জন্য তাঁতিরা তিন জনের দল বানিয়ে নিতো। একজন প্রধান তাঁতি, একজন সহকারী তাঁতি এবং আরেক জন শিক্ষানবিশ তাঁতি।
একটি মসলিন কাপড় তৈরি করে প্রধান তাঁতি মাত্র ১ দিনার পেতেন। সহকারী তাঁতিকে প্রধান তাঁতি নিজ আয়ের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ দিতেন। ১০-১২ বছর বয়সী ছেলেদেরকে শিক্ষানবিশ তাঁতি হিসেবে নেয়া হতো। তাদেরকে বেতন না দিলেও খাওয়া-পরার দায়িত্ব নেয়া হতো। প্রধান তাঁতির বার্ষিক আয় দিয়ে ৫৫ থেকে ৭০ মণ চাল কেনা যেতো। সহকারী তাঁতির ক্ষেত্রে তা হতো ১৫ থেকে ৩০ মণ। এ পরিমাণ ধীরে ধীরে আরো কমতে থাকে।
পলাশী যুদ্ধে বাংলার নবাবের শোচনীয় পরাজয়ের পর ইংরেজরা সমস্ত কিছুতে কর্তৃত্ব স্থাপন করে। বাংলা থেকে অনেক ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠী চলে যায়। ১৮ শতকে ইংরেজরা ইউরোপে মসলিন উৎপাদনের চেষ্টা করলেও তা ঢাকাই মসলিনের সমকক্ষ হয়নি। মেঘনার তীরে পলি পড়া জমিতে ফুটি কার্পাসের ব্যাপক চাষ হতো। পাশাপাশি ঢাকার আর্দ্রতা ও জলবায়ু ছিলো মসলিন বোনার জন্য পুরোপুরি উপযোগী।
খুবই বিত্তশালীরাই মসলিন কিনতো। এর দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে ছিলোনা। মসলিন তৈরির পর তাঁতিদের থেকে এগুলো কিনে নিতো মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। তারপর আরো চড়াদামে বিক্রি হতো উচ্চবিত্তদের কাছে। পুরো চক্রটি বাংলার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ইংরেজ শাসনামলে ইউরোপীয়রা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে প্রাধান্য লাভ করে। তাই তাঁতিদের লাভের পরিবর্তে উল্টো আরো ক্ষতি হতো। আবার ইউরোপের কাপড়ের ব্যবসা বাড়াতে ইংরেজরা মসলিন সহ দেশি কাপড়ের উপর ৭০-৮০ শতাংশ করারোপ করে। আর বিলেতি কাপড়ে মাত্র ২-৪ শতাংশ কর আরোপিত হয়। ফলস্বরূপ একসময় মসলিন কাপড় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এদেশের মসলিন শিল্প ধ্বংসের জন্য ইংরেজরা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে।
এরপর বহুকাল বাংলার মসলিনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধুলোয় চাপা পড়ে ছিল। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধামন্ত্রী মসলিনের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দেন। ফলে ঢাকাই মসলিন তৈরির জন্য কাজ শুরু করেন একদল গবেষক। তাঁরা দীর্ঘ ছয় বছর বহু প্রচেষ্টা ও ব্যাপক গবেষণা করেন। অবশেষে তৈরি করা সম্ভব হয় ৬টি মসলিন শাড়ি। আবিষ্কৃত এই মসলিন শাড়িগুলো বাংলার গৌরব সেই ঢাকাই মসলিন কিনা, তাও বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন গবেষকরা।
মসলিন ফিরিয়ে আনতে ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ নামক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রধান বৈজ্ঞানিক নিযুক্ত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন। গবেষকগণ লিনিয়াসের ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আব্দুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’ প্রভৃতি বই থেকে ফুটি কার্পাস উদ্ভিদের বহু বৈশিষ্ট শনাক্ত করেন। তাঁরা সারাদেশ থেকে অনেক নমুনা সংগ্রহ করেন। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে বাংলার হারিয়ে যাওয়া আসল মসলিন সংরক্ষিত রয়েছে। গবেষকগণ সেখান থেকেও নমুনা সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত সম্ভাব্য সকল তুলাগাছ ও আসল মসলিনের সুতার ডিএনএ তুলনা করা হয়। তারপর প্রকৃত ফুটি কার্পাস উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়। বহু প্রচেষ্টা ও সাধনার পর তৈরি করা হয় বাংলার হারিয়ে যাওয়া মসলিন।
মসলিন আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। পরিকল্পিতভাবে বাংলার এ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। দেরিতে হলেও আমরা সেই শিল্পকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি এবং সফল হয়েছি। মসলিন আবারো বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখুক- এটাই কাম্য।
(সমাপ্ত)