আকাশ পাহাড়ের সৌন্দর্য-আমেরিকার স্মোকি মাউন্টেনস ন্যাশনাল পার্ক
আমেরিকার ন্যাশনাল পার্কের কনসেপ্টটা আমার কাছে বেশ ভালো লাগে। কোন একটা বড় এলাকার জীববৈচিত্র্য আর প্রকৃতিকে সংরক্ষণের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সেটাকে ন্যাশনাল পার্কের আওতায় নিয়ে আসা। পুরো আমেরিকায় এমন ৬২টা ন্যাশনাল পার্ক আছে এবং সেগুলোর অধিকাংশই আয়তনের দিক থেকে বেশ বড়। আমেরিকার যতগুলো ন্যাশনাল পার্ক ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত তার মধ্যে গ্রেট স্মোকি মাউন্টেনস ন্যাশনাল পার্ক একটা।
পার্কটা আমেরিকার দক্ষিণের টেনেসি আর নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের বেশ কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত। শীতের শুরুতে যখন এখানে গাছের পাতারা ঝরে পড়ার আগ মুহূর্তে রং বদল করে হলুদ, কমলা, লাল, সোনালি রঙে ভরে ওঠে (যেটাকে ফল কালার বলে), তখন সেই সুন্দরের টানে এখানে মানুষের ঢল নামে। এছাড়াও সারাবছর এই পার্কে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এটা এখনো পর্যন্ত আমেরিকার সর্বাধিক বেশি ভ্রমণকৃত ন্যাশনাল পার্ক। মহামারীর কারণে বন্ধ হয়ে গেলেও গত জুন মাস থেকে এটা সীমিত আকারে খুলে দেয়া হয়। তখন থেকেই যাওয়ার চিন্তা করছিলাম। বাড়িতে বসে থাকতে আর কত ভালো লাগে! শেষপর্যন্ত অল্প কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে চলে গেলাম এই স্বপ্নিল পাহাড়ের দেশে।
পাহাড়ের ঘন গাছপালা এখানের বাতাসে কিছু জৈবরাসায়নিক পদার্থ ছেড়ে দেয় যা বাষ্পের সাথে মিশে ধোঁয়ার মত দেখায়। সেই ধোঁয়া পাহাড়ের চূড়াগুলোকে প্রায়ই ঢেকে রাখে। অনেক আগে এখানে বাস করা মানুষেরা তাই এর নাম দিয়েছিল স্মোকি মাউন্টেনস। পার্কটা প্রচুর বড় হওয়ায় সবাই সাধারণত গাড়ি অথবা সাইকেলে করে ঘুরে। আর এই চলতি রাস্তায় হঠাৎ হরিণ এসে পড়ে। ভাগ্য ভালো থাকলে ভাল্লুকের দেখাও পাওয়া যায়। তবে পার্কের মাঝে কিছুদূর পরপরেই সাইনবোর্ড দিয়ে সতর্কতা জারি করা আছে যে বন্যপ্রাণীদের কাছে যাওয়া এবং তাদের কোনরকমের খাবার দেয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ কারণ সেটা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এই বিশালত্বের মাঝে যতদূর চোখ যায়, ততদূর পর্যন্ত আকাশের নীল আর পাহাড়ের সবুজ, চোখ আর মন দুটোই ভরে দেয়। আর তাদের মাঝে ঘুরে বেড়ানো অলস মেঘ হঠাৎ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। পাহাড়ের একদম কোলে থাকার ইচ্ছা হলে নির্দিষ্ট ক্যাম্পিং স্পটে ক্যাম্পিং করে থাকার ব্যবস্থাও এই পার্কে আছে। আর তখন প্রতিবেশী হিসেবে কালো ভালুকদের হঠাৎ হঠাৎ খাবারের খোঁজে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।
এই পাহাড় আর বনভূমি একসময় আয়তনে আরো বড় ছিল। সেসময় এখানে স্থানীয় মানুষজন যারা চেরোকি (Cherokee) নামে পরিচিত তারা বাস করত। আমেরিকায় ইউরোপিয়ানদের আগমনের পরে তাদের অনেকেই এখানে থেকে বিতাড়িত হয়। সেসময় লগ কাঠের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ের অনেক বনভূমি নির্বিচারে গাছ কেটে উজাড় হয়ে যায়। সেটা থামাতেই একে ন্যাশনাল পার্কের আওতায় নিয়ে আসা হয়। অল্প কিছু সংখ্যক চেরোকি এখনো পাহাড়ের আশেপাশে থাকে যারা এর মায়া কখনোই ছাড়তে পারেনি।
দিগন্তজোড়া পাহাড় ছাড়াও আরো এক বিশালত্বের দেখা এখানে মেলে। রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকলে আমাদের মিল্কিওয়ে ছায়াপথের বেশ কিছুটা অংশ এখানে থেকে দেখা যায়। ছোটবেলার মত তারা গোণার সময় হাতে আর এখন থাকেনা, চেষ্টাও করা হয়ে ওঠেনা। শহরের সংকীর্ণ আকাশে বিল্ডিং এর ফাঁকে শুধু চাঁদটাকেই চোখে পড়ে, তারাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। পাহাড়ে সে বাধা নেই, আকাশ এখানে অবারিত, মুক্ত। নিচে জোনাকির আলো আর ওপরে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাদের আলো এক অনন্যসুন্দর ভালোলাগার আবহ তৈরী করে যা মনে গাঁথা পড়ে যায়। এমন আকাশ দেখেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান”।মুগ্ধ হয়ে সেই ছায়াপথের আলো দেখতে গিয়ে হঠাৎ কিছু তারাদের খসে পড়তেও দেখা যায়। এই অনুভূতি যে আসলে কতোটা সুন্দর সেটা সত্যিই আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব না। তবে আশা রাখি বেঁচে থাকলে আবারও একদিন এই পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে যাব।