ঝি ঝি ধরা সমস্যা ও সমাধান
কোনো কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে মনে হলো, হাতে বা পায়ে অনেকগুলো সূঁচ বিধে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই মনে হওয়া বা মেডিকেল কন্ডিশনটাকে সহজ বাংলায় ‘ঝি ঝি ধরা’ বলা হয়। এর ইংরেজি নাম Paresthesia. এই অনুভূতিটা তেমন যন্ত্রনা দায়ক না হলেও অন্যরকম একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। তখন মনে হয় শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গে অনেক গুলো পোকা কিলবিল করছে। আবার কখনো মনে হয় অনেকগুলো সূঁচ একসাথে বিধে যাচ্ছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক এই মেডিকেল কন্ডিশনটি কখনো কখনো অস্বাভাবিক পর্যায় চলে যেতে বিন্দু মাত্র সময় নেয় না।
কখন বুঝবেন আপনার “ঝি ঝি ধরা” বড় কোনো রোগের পূর্বাভাস? কখন বুঝবেন আপনার “ঝি ঝি ধরা” বিষয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিৎ? চলুন জেনে নেই।
“ঝি ঝি ধরা” আসলে কি?
এটা মূলত স্নায়ুজনিত একটা সমস্যা। ঠিক সমস্যা না। স্নায়ুতে চাপ লাগলে এই “ঝি ঝি ধরা” অনুভূতিটা হয়। তবে এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা প্রচলিত। সেটি হলো-
ঝি ঝি ধরা বিষয়টা সম্পুর্ন রক্তনালি ঘটিত। অর্থাৎ ঝি ঝি ধরার সাথে রক্তনালির সম্পর্ক আছে। রক্তনালি তে চাপ পড়লে কিছু সময়ের জন্য রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অঙ্গ ঠান্ডা হয়ে যায়। কোনো রকম অনুভূতি অনুভব করা যায় না। তাই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আনার জন্য যখন শিথিল হওয়া অঙ্গ সটান করে রাখা হয় তখন ধীরে ধীরে রক্ত প্রবাহ চালু হয়। এতে করে ঐ অঙ্গে কাটা বিঁধার মতো অনুভূতিটা হয়। তবে এটি ভুল ধারণা। এরকম কোনো কিছুর কারণেই ঝি ঝি ধরে না।
তবে আসলে কি হয়? আমাদের মেরুদণ্ড থেকে শুরু করে সারা শরীরে ছড়িয়ে আছে “স্নায়ু”। দেহের সবখানেই আছে এই স্নায়ু। অনুভূতি কিংবা উদ্দীপনা যোগানোই হলো এই স্নায়ুর কাজ। এই স্নায়ু মস্তিষ্ক ও অন্যান্য স্নায়ুর মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে। বসা বা শোয়া কিংবা অন্য কোনো অঙ্গভঙ্গির কারণে অনেকগুলো স্নায়ুর কোনো একটি স্নায়ুতে চাপ পড়লে দেহের ঐ অংশে রক্ত চলাচলকারী শিরার উপরও চাও পড়ে। ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। চাপের কারণে তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছানোর কথা থাকলেও তা বাধাগ্রস্ত হয়। একই সাথে স্নায়ুগুলোও হৃদপিণ্ড থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পাওয়া থেকে বিরত থাকে (যেহেতু রক্ত বহনকারী শিরার উপর চাপ পড়ে) এরকম পরিস্থিতি থেকে যখন চাপ অপসারিত হয় তখন একসাথে প্রচুর পরিমাণ রক্ত অঙ্গ প্রতঙ্গে প্রবাহিত হয় এবং একসাথে প্রচুর পরিমাণ তথ্যও মস্তিষ্কে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই দুয়ের সমন্বয় হওয়ার সময় একটা উত্তেজনার মতো অনুভূতির সৃষ্টি করে। এটাই Paresthesia বা “ঝি ঝি ধরা”
ঝি ঝি ধরার তিনটি ধাপ-
১.কমপ্রেশন টিঙ্গলিং বা চাপ প্রয়োগ হওয়ার মিনিট খানেক পর তিন থেকে চার মিনিটের জন্য স্থায়ী হওয়া অস্বস্তিকর অনুভূতি।
২. ২য় এই ধাপটি শুরু হয় দশ মিনিট পর। এই ধাপে হাতে বা পায়ে অসাড়তা বোধ হয় এবং যতক্ষণ স্নায়ুর উপর চাপ থাকে ততক্ষণ এই অনুভূতি থাকে।
৩. ৩য় ধাপ শুরু হয় চাপ অপসারণ করার পর। একে ইংরেজিতে “পিন এন্ড নিডেলস” বলা হয় এবং এই ধাপটি আগের দুটি ধাপের চেয়েও অসহ্যকর। তবে যদি কোথাও যন্ত্রণা অনুভূতি হয়ে থাকে সেটা পুরোটাই শারীরিক।
**ঝি ঝি ধরা আসলে শরীরের কোন অঙ্গ থেকে কোথায় ছড়ায় আর কোথায় গিয়েই বা শেষ হয় সেটা আসলে জানা যায় না।**
ঝি ঝি ধরলে করণীয়
কোনো কারণে ঝি ঝি ধরলে অসাড় হওয়া অঙ্গটি টানটান করে রাখলে সাধারণত কিছুক্ষণের মধ্যে অঙ্গটি ঠিক হয়ে যায়। হাটা চলার চেষ্টা না করাই ভালো।
ঝি ঝি ধরার প্রকারভেদ
১. Temporary or Transient paresthesia সচরাচর যেটা হয়ে থাকে। এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যায়।
২. Chronic paresthesia জটিল ধরনের। এটা দীর্ঘমেয়াদি এবং বড় রোগের পূর্বাভাস।
কাদের ঝি ঝি ধরা বেশি হয়-
সাধারণত ছোট বড় সব বয়সের মানুষেরই এটা হয়ে থাকে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যাদের যাদের হয় তারা হলেন-
১.যারা ছোট আকারের জুতো পড়ে
২.পায়ের উপর বসলে
৩.বেকায়দায় বসে থাকা মানুষের
৪. Back Pain রয়েছে এমন মানুষের
৫.ডায়বেটিসে আক্রান্ত রোগীদেরও হয়ে থাকে
৬.অনেক বেশি ভিটামিন ডি গ্রহণ যারা গ্রহণ করেন
বড় যেসকল অসুখের সময় ঝি ঝি ধরা অনুভূত হতে পারে-
১.ডায়বেটিস
২.স্ট্রোক করলে
৩. কোনো কারণে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ থেমে গেলে
৪.যকৃত বা বৃক্কের অসুখ হলে
৫.মস্তিষ্কে টিউমার হলে
কখন ঝি ঝি ধরা দীর্ঘস্থায়ী হয়-
* কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার ক্ষেত্রে
*HIV এর ঔষধ, খিঁচুনির ওষুধ বা বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক ব্যাবহারের ফলে
*সীসা বা রেডিয়েশনের মতো বিষাক্ত বস্তুর সংস্পর্শে এলে
*পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের অভাব হলে
*অসুস্থতা বা কোনো আঘাতের কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে
*অতিরিক্ত মদ্যপান
*বিশেষ ক্ষেত্রে চেতনানাশক ব্যবহারের পর
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে?
*দীর্ঘসময় ঝি ঝি ধরার মতো উপসর্গ থাকলে
*কোনো অঙ্গে নিয়মিত ঝি ঝি ধরার ঘটনা ঘটলে
ঝি ঝি যাতে না ধরে তাতে করণীয়
*সঠিক ভাবে বসতে হবে
*স্নায়ুতে যেন চাপ না লাগে
*মাঝে মাঝে কাজ করার সময় বিরতি নিয়ে হাটাহাটি করতে হবে
*ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
*নিয়মিত ব্যায়াম
*ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলতে হবে
ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আজ এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন।