ইতিহাসের সাক্ষী || পানাম নগর
নারায়গঞ্জ জেলার সোনারগাঁওতে কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা পানাম নগরের অবস্থান। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ এর শাসনামলে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে প্রায় ২০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠে পানাম নগর। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে ধলেশ্বরী, পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা – চারদিকে নদী বেষ্টিত সোনারগাঁওয়ের ভৌগোলিক অবস্থান দেখলেই প্রাচীন বাংলার রাজধানী হবার তাৎপর্যটুকু বোঝা যায়।এমন ভৌগোলিক অবস্থান ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত। উল্লেখ্য ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ এর আমলে বর্তমান সোনারগাঁও “সুবর্ণ গ্রাম” নামে পরিচিত ছিল।
ইবনে বতুতা চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সোনারগাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-নগরী রূপে বর্ণনা করেন ।
এরই ধারাবাহিকতায় এখানে গড়ে ওঠে এক অভিজাত শ্রেণি, যারা ছিলেন মূলত বণিক বা ব্যবসায়ী।তাদের ব্যবসার সুবিধার্থে এখানে গড়ে ওঠে বড় নগর ,খাস নগর,পানাম নগর নামে তিনটি নগরী।পরবর্তীতে ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ধনী হিন্দু বণিকদের দ্বারা পানাম নগরের প্রসার ঘটে।তখন এ এলাকা প্রসিদ্ধ ছিলো মসলিন কাপড় ও নীল ব্যবসার জন্য।
তখনকার ইতিহাসবিদ জেমস টেলরর পানাম নগরকে মসলিন শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ বলে উল্ল্যখ করেছেন।
একসময় জাকজমকপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে এটি বলতে গেলে এক মৃত নগরী।২০০৬ সালে World Monument Fund ১০০ টি ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকায় পানাম নগরকে অন্তর্ভূক্ত করে।যাতাইয়াতের জন্য এ নগরীর মধ্য দিয়ে প্রায় ৬০০ মিটার দীর্ঘ,৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ঠ রাস্তা চলে গেছে।রাস্তার দু ধারে অর্থাৎ উত্তর দিকে ৩১ টি , দক্ষিণদিকে ২১টি একতলা , দ্বিতল ,তিনতলা এরকম ৫২ টি ভবন রয়েছে ।স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সাথে মোঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। ভবনের প্রসস্থ দেয়াল গুলো ইট আর সুরকি দিয়ে তইরী।দেয়াল গুলোতে নানা ধরনের নকশা, রঙিন কাঁচ, পাথর, কড়ি, চিনামাটি, টেরাকোটা ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।বাড়িগুলোতে কাস্ট আয়রনের নিখুঁত কাজ আছে, এবং ইউরোপে ব্যবহৃত কাস্ট আয়রনের কাজের সাথে এই কাজের অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও মেঝেতে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ লক্ষ্যনীয়।
পানাম নগর ছিল একটি পরিকল্পিত নগরী। নগরীর পানি সরবাহের জন্য দুপাশে ২টি খাল ও ৫টি পুকুর আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে কুয়া বা কূপ। নগরীকে জলাবদ্ধতামুক্ত রাখতে করা হয়েছে খালের দিকে ঢালু। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে যথেষ্ট দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া নগরী সুরক্ষিত গেইট দ্বারা আবদ্ধ।নগরীর অধিবাসীদের নিরাপত্তার জন্য সন্ধ্যার পূর্বেই গেইটসমূহ বন্ধ করে দেয়া হতো ।
এছাড়া এখানে আছে ইংরেজদের নীলচাষের নির্মম ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে পানামের নীলকুঠি ,পানাম-দুলালপুর পুল,পানাম পুল, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসনামলে নির্মিত একটি মসজিদ। মসজিদটির নাম গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে রয়েছে এই মসজিদ। মগরাপাড়া থেকে দক্ষিণ দিকে আরও কিছু ইমারত আছে যেমন বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তার বংশধরদের মাজার, দমদম দূর্গ ইত্যাদি। পানাম নগরে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। ঈসা খাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ফতেহ শাহের মাজার, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজার, চিলেকোঠা সহ অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। পানাম নগরের কাছেই বড় সর্দারবাড়ি, শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর অবস্থিত ।১০/১৫ মিনিটের পথ হেঁটেই যাওয়া যায় ।দর্শনার্থীরা চাইলে মেঘনা নদী ,নদী পার হলেই মায়া দ্বীপ হতে ঘুড়ে আসতে পারেন।
যেভাবে যাবেনঃ
ঢাকার গুলিস্তান থেকে বোরাক,স্বদেশ,দোয়েল নামের বাসে করে সোনারগাঁ মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে।বাস ভাড়া ৫০-৬০ টাকা নিবে। তারপর রিক্সা অথবা সিএনজি তে করে যেতে হবে লোকশিল্প জাদুঘর ।কেউ চাইলে নিজস্ব যানবাহন নিয়েও যেতে পারেন। জাদুঘরের
সাথেই আছে পার্কিং স্থান। এখান থেকে উত্তর দিকে পানাম নগরের অবস্থান ।১০/১৫ মিনিটের পথ;চাইলে হেঁটেই যেতে পারবেন।
যেখানে থাকবেনঃ
ঢাকার আশে পাশে হবার কারণে এখানে দিনে যেয়ে দিনেই ফিরতে পারবেন। রাতে থাকার জন্য এখানে কোন ব্যবস্থা নেই। রাতে থাকতে হলে একটু দূরে সোনারগাঁ উপজেলা সদর বা নারায়ণগঞ্জ শহরে এসে থাকতে হবে।
সোনারগাঁ উপজেলা সদরে থাকার জায়গার নাম ও ঠিকানা দেয়া হলোঃ
- রয়েল রিসোর্ট – কাশনগর দিঘীরপাড়, সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ।
- হোটেল মীনা – ১৬ মহিম গাঙ্গুলী রোড, টানবাজার, নারায়নগঞ্জ।
- হোটেল নারায়ণগঞ্জ – ১নং সিরাজউদ্দৌলা রোড, নারায়নগঞ্জ।
- হোটেল মেহেরান – সনাতন পাল লেন রোড, নারায়ণগঞ্জ।
- হোটেল সুগন্ধা – লিয়াকত সুপার মার্কেট, ১২/২০ দিগু বাবুর বাজার, নারায়ণগঞ্জ।
- হোটেল সোনালী – ১নং রেলগেট, সনাতন পাল রোড, নারায়ণগঞ্জ।
আর এখানে খাবারের জন্য মনির রেস্তোরা ,খাবার ঘর ,আলহাজী বিরানী হাউস, আজমীরী বিরানী হাউস,আমান হোটেল তো আছেই । একটু সময় করেই বন্ধু অথবা পরিবারের সাথে করেই ঘুরে আসতে পারেন ঐতিহ্যবাহী এ নগর থেকে ।