খেলাফতের ইতিহাস : শুরু থেকে শেষ (দ্বিতীয় পর্ব)
আব্বাসীয় খেলাফত (৭৫০-১২৫৮)
উমাইয়া খেলাফতকে ক্ষমতাচ্যুত করে মুসলিম সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব নেয় আব্বাসীয় রাজবংশ। মহানবী (সা.) এর চাচা আব্বাস (রা.) এর বংশধরদের কর্তৃক ৭৫০ সালে ইসলামের তৃতীয় এ খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। সুদীর্ঘ ৫০৮ বছর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়ে আব্বাসীয়রা পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘকালীন শাসনের রেকর্ড গড়ে তুলেন। আবুল আব্বাস আস-সাফফাহর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এ সাম্রাজ্য আবু জাফর আল মানসুর, হারুন অর-রশীদ এবং আল মামুনের মতো কালজয়ী শাসকদের নেতৃত্বে এক গৌরবান্বিত ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
সর্বমোট ৩৭ জন আব্বাসীয় খলিফা দীর্ঘ ৫০৮ বছর কাস্পিয়ান সাগর থেকে নীল নদ এবং আটলান্টিক মহাসাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিশাল এ সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। তবে তাদের শাসনের পুরো সময়টা একদম কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না। শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তারা যতটা মগ্ন ছিলেন, সামরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তারা ছিলেন ততটাই উদাসীন। এ কারণে তাদের বারবার মুখোমুখি হতে হয়েছে বিদ্রোহের, ছেড়ে দিতে হয়েছে শাসন এলাকা, সংকুচিত হয়েছে ক্ষমতা।
আব্বাসীয় শাসনের অন্তিম সময়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ। তাদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির কঠিন শর্ত মেনে নিতে হয় আব্বাসীয়দের। উমাইয়ারা তিন মহাদেশজুড়ে (এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ) একক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করলেও আব্বাসীয়রা তা ধরে রাখতে পারেনি। তাদের সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্য তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খেলাফত, মিশরের কায়রো কেন্দ্রিক ফাতেমীয় খেলাফত, স্পেনের কর্ডোভা কেন্দ্রিক বিচ্ছিন্ন উমাইয়া খেলাফত – একই সাথে তিনটি খেলাফতের কর্তৃত্ব দাবি নষ্ট করে দেয় মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি। আব্বাসীয় খেলাফতকে তার পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ আন্দালুস একজন উমাইয়া যুবরাজের নিকট, মাগরেব আগলাবির নিকট এবং ইফ্রিকিয়া ফাতেমীয় খেলাফতের নিকট ছেড়ে দিতে হয়।
নিভু নিভু সেই প্রদীপটিরও শেষ রক্ষা হয়নি। ১২৫৮ সালে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের বাগদাদ দখলের মাধ্যমে বিলুপ্তি ঘটে ঐতিহ্যবাহী আব্বাসীয় খেলাফতের। হালাকু খান ১২৫৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শেষ আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাসিমকে কার্পেটে মুড়ে ঘোড়ার সাহায্যে পদদলিত করে হত্যা করেন।
আব্বাসীয়রা প্রথমে কুফায় রাজধানী স্থাপন করলেও ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে তা স্থানান্তর করেন বাগদাদে। বাগদাদে বাইতুল হিকমাহ স্থাপন এবং আব্বাসীয় শাসকদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ মনোযোগের কারণে মুসলিম বিশ্ব দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে। এ সময়ে গণিত, আলকেমি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং আলোকবিজ্ঞানসহ প্রতিটি সেক্টরে মুসলিম বিজ্ঞানীরা সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেন।
উমাইয়া খলিফারা যে বিপুল উদ্যমে রাজ্য জয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন, আব্বাসীয় যুগে সেই উদ্যম ব্যয় হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সভ্যতা চর্চায়। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে আব্বাসীয় খেলাফত এক কালজয়ী অধ্যায় রচনা করেছিলো। বাগদাদে আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের আগ পর্যন্ত সময়কে ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
মামলুকদের অধীনে আব্বাসীয় খেলাফত (১২৬১-১৫১৭)
১২৫৮ সালে হালাকু খান কর্তৃক আব্বাসীয় খেলাফত ধ্বংস হওয়ার ফলে মুসলিম বিশ্ব খলিফাশূন্য হয়ে পড়ে। ৬৩২ সালে খেলাফত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রথম নজিরবিহীনভাবে প্রায় তিন বছর মুসলিম জাহান নেতৃত্বহীন ছিলো। খলিফার অনুপস্থিতিতে সর্বত্রই একটা চাপা হাহাকার বিরাজ করছিলো। এ শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন মিশরের মামলুক সুলতানরা। তবে তারা নিজে খেলাফত দখল করেননি, বরং বাগদাদের আব্বাসীয় উত্তরাধীকারীদের হাতে সে দায়িত্ব তুলে দেন।
হালাকু খান শেষ আব্বাসীয় খলিফাসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করলেও ভাগ্যক্রমে কয়েকজন যুবরাজ বেঁচে যান। ৩৫ তম আব্বাসীয় খলিফার পুত্র আবুল কাসিম আহমদ তাদের মধ্যে একজন। ১২৬১ সালে মামলুক সুলতান বাইবার্স তাকেই মুনতাসির বিল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করে খলিফা ঘোষণা করেন। এভাবেই দীর্ঘ তিন বছর পর মামলুকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কায়রোতে আবার যাত্রা শুরু করে আব্বাসীয় খেলাফত। মিশরে মুনতাসির ও তার পরবর্তী বংশধরেরা প্রায় ২৫৬ বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।
কায়রোর আব্বাসীয় খলিফারা মূলত মামলুক সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় আনুষ্ঠানিকভাবে খলিফা ছিলেন। তাদের ক্ষমতা শুধু ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকতো, রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্বের দখল ছিলো মামলুকদের হাতে।বাস্তবে খলিফারা ছিলো শুধুমাত্র মামলুক সুলতানদের হাতের পুতুল। ইসলামী ঐতিহ্যের চিরাচরিত নিয়ম ছিলো খলিফা কর্তৃক সুলতান নিয়োগ। কিন্তু মামলুক সুলতানরা সে নিয়ম ভেঙে উল্টো স্বয়ং খলিফাকেই নিয়োগ দেন।
এ যাত্রায়ও শেষ রক্ষা হয়নি আব্বাসীয় খেলাফতের।১৫১৭ সালের ২২ জানুয়ারি এক যুদ্ধের মাধ্যমে উসমানীয় সুলতান সেলিম মামলুক সালতানাতকে উৎখাত করেন এবং কায়রোর শেষ আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলকে বন্দি করে কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যান। খুব শীঘ্রই মুতাওয়াক্কিলকে খলিফার পদ থেকে অপসারণ করেন এবং সেলিম নিজেই খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবেই মুসলিম খেলাফত আব্বাসীয় থেকে উসমানীয় বংশে স্থানান্তরিত হয়।
শেষ পর্বে আমরা আলোচনা করবো উসমানীয় খেলাফত (১৫১৭-১৯২৪) নিয়ে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।