ওএসডি এর বিস্তারিত
টিভি কিংবা পত্রিকার হেডলাইনে প্রায়ই আসে সরকারি কর্মকর্তা ওএসডি হওয়ার খবর। বিষয়টিকে কেউ দেখেন ইতিবাচকভাবে কেউবা নেতিবাচকভাবে। ওএসডি শব্দটি শুনেই কারো কারো মাথায় ভেসে ওঠে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নামে গুরুতর অভিযোগ কিংবা দুর্নীতির কারণে শাস্তি পাওয়ার ভয়াবহ চিত্র। কিন্তু বিষয়টি আসলেই পুরোপুরি এমন নয়। বিভিন্ন ইতিবাচক কারণেও একজন কর্মকর্তা ওএসডি হতে পারেন। স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে এ ব্যাপারে অনেকেই পড়েন বিভ্রান্তিতে।
ওএসডি হচ্ছে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (Officer on Special Duty) সংক্ষিপ্ত রূপ। সকল দেশের সিভিল সার্ভিসের চাকরিতে ওএসডি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় (বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) এটি দ্বারা দায়িত্বহীন কর্মকর্তাকে বুঝায়। সাধারণত কোনো পদায়নের জন্য অপেক্ষমান, অপরাধের দায়ে বহিষ্কৃত বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে ওএসডি করা হয়।
অন্যান্য দেশের সিভিল সার্ভিসে কিছু কর্মকর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়, যারা অন্যদের চেয়ে বেশি দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে পরিচিত। দেশের প্রয়োজনে তাদের উপর বিশেষ সেই দায়িত্বটি ন্যস্ত করা হয়। আবার দায়িত্ব শেষে স্বপদে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এসব ওএসডি কর্মকর্তাকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয় এবং সবার সেরা অফিসার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে ওএসডি শব্দটি দিনদিন নেতিবাচক হয়ে পড়েছে। এখানে এই স্পেশাল দায়িত্ব কখনোই কোনো ভালো কাজের জন্য দেওয়া হয় না, বরং এটাকে একরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বলা চলে। বাংলাদেশে কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করা মানেই হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ এসেছে, যার ফলশ্রুতিতে তাকে স্পেশাল দায়িত্বে (মূলত দায়িত্বহীন) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাধারণত কোনো কর্মকর্তা অফিসের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করলে, দুর্নীতি বা অন্য কোনো অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়ার জন্য এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া কর্মকর্তার বিপরীতে পদসংকট, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ এবং বিশেষ কাজে নিয়োজিতসহ সরকারের বিভিন্ন প্রয়োজনে যে কাউকে ওএসডি করা হতে পারে।
১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাসে জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচটি কারণে সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়:
১। দুর্নীতি, শৃঙ্খলাজনিত, অসদাচরণ ও অযোগ্যতার জন্য প্রত্যাহার করা কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়। তবে সর্বোচ্চ ১৫০ দিন ওএসডি রাখা যাবে।
২। দুই মাসের অধিক ছুটি ভোগকারী বা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ওএসডি করা যায়।
৩। পুরোনো পদ বা বৈদেশিক চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বৈদেশিক প্রশিক্ষণ থেকে প্রত্যাগত এবং নতুন পদে যোগদানের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন এমন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়।
৪। বৈদেশিক চাকরি বা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশি ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে অপেক্ষমাণ রয়েছেন এমন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়। এ ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব তিন মাস পর্যন্ত ওএসডি রাখা যাবে।
৫। প্রশাসনিক বা অনিবার্য কারণে কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়।
একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এই ওএসডি থেকে মুক্তি দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আগের স্থানে কিংবা অন্য কোনো পদে ফেরত নিয়ে আসা হয়।
বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তারা বেতন, ভাতা, গাড়িসহ সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পান। পান না শুধু কোনো দায়িত্ব। সাধারণত একজন ওএসডিকে অফিসে উপস্থিত হয়ে স্বাক্ষর করা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে হয় না। সচিবালয়ের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিন হাজিরা দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে দাপ্তরিক সময় পার করতে হয় তাদের।
যদিও একজন ওএসডিকে তার বিল উঠানোর কাগজপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেখাতে হয়, তবুও সেই কর্মকর্তাদেরকে কোনো চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয় না। তারা সাধারণত মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে বসে থাকেন। লাইব্রেরিই মূলত তাদের অফিস কক্ষ। এখানে বসে তারা বই পড়েন কিংবা সমমনা অন্য বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে গল্পগুজব করে সময় পার করেন। কেউ যদি কোনো ওএসডি কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে আসেন, তাহলে তাকে সচিবালয়ের লাইব্রেরিতে কিংবা ক্যান্টিনে আসতে হবে।
বিষয়টি চাকরির একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও ওএসডি হওয়া কর্মকর্তারা এক ধরণের অস্বস্তি নিয়েই বেঁচে থাকেন। সমাজের মানুষগুলোর চোখে তারা হয়ে যান মর্যাদাহীন। কারো কাছেই নিজের নির্দিষ্ট পরিচয় দিতে পারেন না। কারণ, পদ থাকার পরেও এসময় কোনো কাজ করতে পারেন না তারা। নিজের অধীনে কোনো দায়িত্ব না থাকায় বিষয়টিকে অনেকটাই শাস্তি হিসেবে মনে করেন কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ওএসডি কর্মকর্তাদের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে দেশবাসীও বঞ্চিত হয় তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।