দেজা ভ্যু – মনের এক রহস্যময় অদ্ভুত অনুভূতি
দেজা ভ্যু আমরা সবাই কম বেশী অনুভব করেছি । নতুন কিছু দেখলে আমাদের মাঝে মাঝে মনে হয় এটা কোথায় যেন দেখেছি । কিন্তু তারপরই মনে হতে থাকে এটা তো এতোটা পরিচিত মনে হবার কথা নয় ! এটাই আসলে দেজা ভ্যু এর অনুভুতি । আপনি কোন কিছুকে মনে করছেন আগেই কোথাও দেখেছেন, সুস্পষ্টভাবে তা মনে করতে পারছেন না । কিন্তু আপনার অনুভব হবে যে এটা স্বাভাবিকের থেকেও বেশী চেনা চেনা মনে হচ্ছে যেটা আসলে এতোটা পরিচিত মনে হবার কথা না । আমারা অনেকই এই অনুভুতিকে অতিপ্রাকৃত এবং রহস্যপূর্ণ মনে করি । যেহেতু এই অনুভুতি সচারচর দেখা যায় না তাই একে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করে গবেষণা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় । কিন্তু বিজ্ঞানীরা কিছু উপায় তৈরি করেছেন । তারা হিপনোটাইস এবং ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ব্যাবহার করে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে দেখেন । কম বয়সী তরুন-তরুণীদের এই অনুভুতি বেশী হতে দেখা যায় । এর প্রথম অনুভুতি ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যেই অনুভূত হয় ।
দেজা ভ্যু কেমন ?
দেজা ভ্যু একটি ফরাসি শব্দ । এর মানে হচ্ছে “ Already Seen ” । যা আগেই দেখা হয়ে গেছে । দেজা ভ্যু একটি অদ্ভুত এবং ভূতুরে অনুভুতি । অনেকেই এটাকে অনুভব করেছেন । আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন , হাঁটার সময় পাশে একটা লেক দেখে মনে হলো কোথায় যেন আপনি লেক টি দেখেছেন । কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না । লেকটি দেখে আপনার এতোটা সুপরিচিত মনে হবার কথা নয় । কিন্তু তবুও আপনার মনে হচ্ছে কোথায় যেন আগে লেকটি দেখেছেন । আপনি অবশ্যই আগেও অনেক লেক দেখেছেন । কিন্তু কখনই এইরকম অনুভুতি আসেনি । মনে হবে যেন পূর্বের কোথার সাথে যেন একটা সংযোগ রয়েছে । অথচ আপনি প্রথমবারই এই লেকটিকে দেখছেন ।
দেজা ভ্যু আসলে অস্বাভাবিক কিন্তু আশ্চর্যজনক অনুভুতি । এটাই আমাদের বলে দেয় আমাদের মস্তিষ্ক এবং মেমোরি কিভাবে কাজ করে ।
উপরের চিত্র টি লক্ষ্য করুন । আপনি টিভিতে দেখলেন একটা ছাগলের পিঠে বানর বসে আছে । এটা যদিও হাস্যকর কিন্তু পরে আপনি দেখলেন একটি ঘোড়ার পিঠে মানুষ বসে আছে । এই দুই ঘটনা একই রকম । ঘোড়ার পিঠে মানুষ দেখে মনে হবে “ আরে ! আমি তো কিছুক্ষণ আগে এই রকম ঘটনা দেখেছি” । এই রকম ঘটনার সাথে আপনি কিছুক্ষণ আগেই পরিচিত হয়েছেন । এবং এই পরিচিতি টা পুরোপুরি যথাযথ । আপনি দুটো বিষয়ের পার্থক্য এবং মিল আলাদা করতে পারছেন । আপনার মনে কোন রকম দ্বন্দ্ব নেই । তাই এটা দেজা ভ্যু নয় ।
কিন্তু পরে আপনি দেখলেন মাঠে অনেকগুলো ঘোড়া একসাথে ঘাস খাচ্ছে । তখন আপনার মনে হবে এটা কিছুর সাথে মিলে যাচ্ছে । কিন্তু এই মিলটা পুরোপুরি পরিস্কার নয় । অবশ্যই আপনি আগেও ঘোড়া দেখেছেন । কিন্তু এই চেনা চেনা ভাব ওইরকম স্বাভাবিক না যেরকমটা হওয়ার কথা ছিল । ঘোড়ার ঘাস খাওয়া ছাগলের পিঠে বানরের সাথে পরিচিত পরিচিত মনে হলেও তা যথাযথ নয় । কোথায় যেন একটা গড়মিল মনে হয় । এটাই দেজা ভ্যু ।
দেজা ভ্যু কি সচারচর ঘটে?
এই অদ্ভুত অনুভূতি সচারচর পাওয়া যায় না । আপনি যদি সম্প্রতি এই অনুভূতি পেয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে ভাগ্যবান বলা যায় । তবে বিজ্ঞানীরা ঠিক কতো মানুষ সচারচর এগুলোর অভিজ্ঞতা লাভ করে তা এখনো সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে পারেনি । কারন অল্প কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে এর ধরন নির্ণয় কঠিন। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে এর অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করেতে পারেন । পৃথিবীর সবার কাছে থেকে বিজ্ঞানীদের তো আর অভিজ্ঞতা সার্ভে করা সম্ভব না । তবে বেশিরভাগ মানুষ বলেন যে তারা দেজা ভ্যু কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পরপর অনুভব করেন।
কারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটির অভিজ্ঞতা লাভ করেন ?
সচারচর কম বয়স্করা এই অভিজ্ঞতা বেশী লাভ করে থাকেন । খুব কম মানুষই ছয় বছরের আগের এর প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বেশিরভাগ মানুষ এর প্রথম অভিজ্ঞতা পায় ১০ বছর বয়সের মধ্যেই । আসলে ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যেই মানুষ আশেপাশের জগতকে আস্তে আস্তে চিনতে শুরু করে । মিল অমিল খুঁজে বেরায় তাই প্রথম দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতা পেতে একটু সময় প্রয়োজন ।
যখনি আপনি ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে চলে আসবেন তখনই এটা সবচেয়ে বেশী দেখা যাবে । যা আগে কখনোই এক্সপেরিয়েন্স করেননি । কিন্তু পরবর্তীতে এটা আর বেশী দেখা যাবে না । ২৫ বছরের বেশি বয়স বাড়ার সাথে এটা আরো কমে যেতে থাকবে । ২৫ বছর বয়সী মানুষ আরও কম দেজা ভ্যু অভিজ্ঞতা লাভ করেন বলে বিবরন দিয়ে থাকেন । কিন্তু কেন এমনটা ঘটে ? বয়স বাড়ার সাথে সাথে তো স্মৃতি শক্তি জনিত সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কথা । মোটেই কমে যাওয়ার কথা না !
এটা আসলে আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানান দেয় আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে । দেজা ভ্যু আসলে মোটেই স্মৃতি শক্তি জনিত সমস্যার সাথে জরিত নয় । দেজা ভ্যু তখনি ঘটে যখনি আপনার মনে হবে কোনোকিছু অস্বাভাবিক ভাবে অতি পরিচিত লাগা যেটা আসলে এতোটা চেনা চেনা লাগার কথা নয়। আপনার মস্তিষ্কই সংকেত দিবে আপনার এই পরিচিত মনে হওয়াটা আসলে ভুল ।
দেজা ভ্যু আসলে স্বাস্থ্যকর মস্তিষ্কের লক্ষণ যেটা আসলে নির্ণয় করতে পরে পরিচিত মনে হওয়ারটা আসলে ভুল । সম্ভবত যাদের বয়স ২৫ এর বেশী তাদের আসলে এই ভুল নির্ণয় করার ক্ষমতা কমে যায়। তারা মেনেই নেয় যে এটা আসলেই তাদের পূর্ব পরিচিত । তাই তারা এর অভিজ্ঞতা কম অনুভব করেন । এই রকম আরও অনেক দেজা ভ্যু এর ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছেন বিজ্ঞানীরা ।
এটিকে যেভাবে নির্ণয় করেন বিজ্ঞানীরাঃ
দেজা ভ্যু দুই ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যায় । একটি হলো পরীক্ষামূলক ভাবে এবং অন্যটি পর্যবেক্ষণমূলক ভাবে । পর্যবেক্ষণমূলক এর ক্ষেত্রে আসলে যারা সচারচর এর অভিজ্ঞতা লাভ করেন তাদের পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হয় । তাদের এই অভিজ্ঞতা হওয়ার প্যাটার্ন , লিংক , কতদিন পরপর ঘটে এবং কখন ঘটে তা খুতিয়ে দেখা হয় । পর্যবেক্ষণমূলক পরীক্ষা নিরিক্ষা আমাদের বলে যে তরুণদের এই ঘটনা বেশী ঘটতে দেখা যায় ।
বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষাও করেন । দেজা ভ্যু এর অভিজ্ঞাতা এনে দিতে মানুষের কানে গরম পানি ছেটানো হয় । এর উদ্দেশ্য হলো বিজ্ঞানীরা যদি এর কারন জানতে পারেন তবে এর অনুভূতি উদ্রেগের কারন ও জানতে পারবেন । মানুষের মস্তিষ্কে আসলে কি ঘটে এবং তা কি প্রক্রিয়ার তৈরি হয় তা ও জানতে পারবেন।
পরীক্ষামূলক ভাবে দেজা ভ্যু পর্যবেক্ষণ চমকপ্রদ মনে হলেও এটা আসলে করা খুবই কঠিন কাজ । হয় মানুষকে হিপনোটাইজ করা হয় । না হয় তাকে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মাধ্যমে এই অভিজ্ঞতা দেয়া হয় । অনেক সময় এটা জানা সম্ভব হয় না যে আসলেই কি তারা সত্যি সতিই এই ভূতুরে অভিজ্ঞতা লাভ করছেন কিনা । অনেকে হয়তো সত্যি সত্যি এই অভিজ্ঞতা লাভ না করলেও বলে থাকেন যে তারা এই অভিজ্ঞতা লাভ করছেন । তখন বিজ্ঞানীদের এর সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় থাকে না ।
এটা কিছুটা এইরকম , যখন শিক্ষক ক্লাসে জিজ্ঞেস করেন কতোজন দেজা ভ্যুর অভিজ্ঞাতা লাভ করেছে । তখন হয়তো অনেকের দেখে কোন ছাত্র হাত তুলবে । যদিও তার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে সে নিঃশ্চিত নয় । এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এটাই ঘটে যখন কৃত্রিমভাবে দেজা ভ্যুর অভিজ্ঞাতা দেয়া হয়। তারা হয়তো রিসার্চারদের খুশি করার উদ্দেশে হ্যাঁ বলে থাকেন ।
কি ঘটে মস্তিষ্কে যখন দেজা ভ্যু অনুভূত হয় ?
দেজা ভ্যু কেন অনুভূত হয় এটা একটা রহস্য । বিজ্ঞানীদের কাছে এটা খুবই চমকপ্রদ জিনিস । বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞাতা থেকে বিজ্ঞানীরা সহজেই এর বৈশিষ্ট্য বের করে ফেলতে পারেন। তবে এই অভিজ্ঞাতা মৃগী রোগে যারা আক্রান্ত তারা বেশী অনুভব করে থাকেন । মৃগী রোগে আক্রান্ত রোগীদের খিচুনি দেখা দিলে তা ব্রেনের অনেক কোষকে প্রভাবিত করে । অনেকসময় মস্তিষ্কের সকল কোষই আক্রান্ত হয় । ফলে কিছু সময়ে জন্য তাদের শরীরের ওপরে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না ।
মৃগী রোগের খিচুনি প্রথমে টেম্পোরাল লব থেকে শুরু হয় । তারপর আস্তে আস্তে তা পাশের কোষে পর্যায়ক্রমে ছড়াতে থাকে । টেম্পোরাল লব আপনার কানের একটু উপরে অবস্থিত এবং এটা মেমোরি তৈরি ও কোন কিছু মনে রাখাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে ।
টেম্পোরাল লব এবং ফ্রন্টাল লব দেজা ভ্যু তৈরিতে ভুমিকা পালন করে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। মৃগী রোগে আক্রান্ত অনেকেই বলছেন যে তাদের খিচুনি ওঠার পর কিছু সময়ের জন্য দেজা ভ্যু অভিজ্ঞাতা লাভ করেন । এটি বিজ্ঞানীদের জন্য একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ক্লু হিসেবে কাজ করে । এটা বলে দেয় যে এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা টেম্পোরাল লব এর জন্যই দায়ী । দেজা ভ্যু হতে পারে টেম্পোরাল লবের ক্ষুদ্র খিচুনি যা শরীররে অন্য জাগায় ছড়াতে দেয় না । মানে খিচুনি শুধু টেম্পোরাল লবেই দেখা যায় এবং সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় মস্তিষ্কের অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই ।
চেনা চেনা অনুভুতি টেম্পোরাল লব থেকেই শুরু হয় । কিন্তু মস্তিষ্কের অন্য অংশ দ্বারা এই অনুভূতি বাতিল হয়ে যায় , এবং সিগন্যাল পাঠায় যে এটা তার পূর্ব পরিচিত নয় । এই দুটি বিপরীত সিগন্যালই দেজা ভ্যুর অনুভূতি দেয় । খুব সম্ভবত ফ্রন্টাল লবই এই চেকিং এর কাজ করে থাকে । ফ্রন্টাল আমাদের চোখের ওপর অবস্থান করে এবং বিভিন্ন ডিসিশন তৈরিতে কাজ করে ।
সারসংক্ষেপঃ
সবশেষে দেজা ভ্যু আমাদের এক অদ্ভুত অনুভূতি দেয় এবং আমরা এর সাথে সাথেই বুঝতে পারি যে এই চেনাচেনা অনুভূতি আসলে ভুল । এই দ্বন্দ্বই অদ্ভুতুরে অনুভূতি দেয় । বিজ্ঞানীরা এখনও এর রহস্য উন্মোচনে কাজ করছেন । অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো আমরা এর সঠিক কারণ জানতে পারব ।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.scientificamerican.com/article/can-science-explain-deja-vu/
https://kids.frontiersin.org/article/10.3389/frym.2015.00001