আটলান্টিক পাড়ের এক মায়াবী সন্ধ্যা (ফ্লোরিডা ভ্রমণ)
সমুদ্র আমাদের সবসময়েই ভীষণ পছন্দের। অবিরাম এই ঢেউ ভাঙা-গড়ার খেলা সারাদিন দেখলেও কখনো পুরনো মনে হয়না, মুগ্ধতাই থেকে যায় প্রতিবারে। প্যানডেমিকের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ফ্লোরিডাসহ আমেরিকার সমুদ্র তীরবর্তী রাজ্যগুলোর অধিকাংশ সৈকতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। গ্রীষ্মের শুরুর দিকে যখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে থাকে তখন এই সৈকতগুলো ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম এই সংকটকালে আর কোথাও ঘুরতে যাব না। কিন্তু দীর্ঘ তিনমাস বাসায় বন্দীদশার মানসিক অস্থিরতা দূর করতে একবারের জন্যে হলেও সমুদ্রের দেখা পেতে খুব ইচ্ছা করছিল।
ইউনিভার্সিটির মাঠে এক বিকেলে হাঁটতে গিয়ে দেখি, স্বাভাবিকের চেয়ে বড় একটা চাঁদ ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। ভুলেই গেছিলাম যে আগামীকালই বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এই মায়া জ্যোৎস্নায় সমুদ্র দেখার ইচ্ছা আরো তীব্র হল। বাসায় ফিরেই ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিলাম পরদিন সমুদ্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার জন্য। এমন পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ কোথাও ঘুরতে যাবার মাঝে একটা অন্যরকম আনন্দ আছে।
গাড়িতে ঘুম পেলেও জোর করে জেগে ছিলাম সেই সুন্দর রাস্তার অপেক্ষায় যেটায় উঠলেই দু’পাশের নীলাভ-সবুজ নোনাজল আর শুভ্র বালির সৈকত বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। সমুদ্রে বেড়াতে এলে আমরা রাত হওয়ার আগে পর্যন্ত পুরো সময়টা সৈকতে থেকেই সমুদ্র দেখে কাটিয়ে দিই। দেখে দেখে চোখ আর মন দুটোই জুড়িয়ে নিই যেন আবার ফিরে আসার আগে পর্যন্ত এই নোনাস্পর্শের স্মৃতিটুকু অমলিন থেকে যায়। মিহি সাদা বালিতে পা ডুবিয়ে এই আছড়ে পড়া ঢেউ, আকাশের রংবদল, সামুদ্রিক পাখিদের মাছ ধরার প্রচেষ্টা এইসব দেখতে দেখতে সব ক্লান্তি ভুলে থাকা যায়। পাখিদের পাশাপাশি মানুষেরাও মাছ ধরার অপেক্ষায় থাকে। তাদের জন্য আলাদা করে পিয়ার তৈরী হয়েছে যেটা তীর থেকে সমুদ্রের গভীর পর্যন্ত চলে গেছে। পড়ন্ত বিকেলে সেই পিয়ারে দাঁড়িয়ে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে ডুবন্ত সূর্যকে দেখতে অসাধারণ সুন্দর লাগে। নানান রঙে আকাশ রাঙিয়ে ডুবতে থাকা এই সূর্য তার মাঝে কতই না রং লুকিয়ে রেখেছে!
দিনের আলো পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দেখি আকাশের অন্যপাশে থেকে বিশালাকৃতির লালচে এক চাঁদ উঠছে। জ্যোৎস্নায় সমুদ্র দেখা এই আমার প্রথম। মুগ্ধ হয়ে সমুদ্র আর চাঁদ দেখতে দেখতে হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি জলের কাছাকাছি অনেকগুলো রে মাছ সাঁতরে চলেছে। বিশাল ছড়ানো পাখা আর লেজের জন্য জলের নীচেও তাদের দেখে মনে হয় যে পাখির মতো উড়ে চলেছে। এই অপার্থিব সৌন্দর্য আমার ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আটলান্টিক পাড়ের এই মায়াবী সন্ধ্যার ঘোর কাটতে অনেকদিন লেগে যাবে।
লালচে গোলাপি চাঁদটা ওপর উঠতে উঠতে ফিকে হলুদ থেকে একসময় তার চিরাচরিত সাদা রঙে ফিরে যায়। আর রাত বাড়তে আমরাও ফিরে যাই ভাড়া করা ক্যাম্পারে। পরদিন যতোটুকু সময় পেয়েছিলাম, আবারো সৈকতে ঘুরতে ঘুরতে স্মৃতি জমা করতে থাকি। সমুদ্র থেকে ফিরে আসার সময় প্রতিবারেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফেরার সময় আবারো যতক্ষণ সমুদ্র দেখা যায় তাকিয়ে ছিলাম তৃষ্ণার্তের মতো। এই আদিম জলরাশি আর তার গর্জনের মাঝে একটা দারুণ মোহ আছে যার জন্য বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছা করে। এই লেখা যখন লিখছি তখনো মন বারবার বলছে আবার কবে সমুদ্রে যাব। আজকাল আয়নার সামনে গেলে সাজিয়ে রাখা ঝিনুকগুলো যখনই চোখে পড়ে তখন সেই স্নিগ্ধ বালুবেলার ছবি প্রতিবার মনের কোণে ভেসে ওঠে।