পাট দিবসে ফিরে আসুক পাটের হারানো ঐতিহ্য
পাটকে বলা হয় সোনালী আঁশ। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। পাট বাংলার শত বছরের ঐতিহ্যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্র সহ নানা পর্যায়ে পাট আমাদের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। অথচ এক সময়ের প্রধান অর্থনৈতিক ফসল-পাট ধীরে ধীরে জৌলুস হারাতে থাকে। পাটের হারানো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ প্রথম বারের মতো জাতীয় পাট দিবস পালন করে বাংলাদেশ।
১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাটের হাত ধরে দেশে ৭৭ টি জুট মিল গড়ে উঠে। এই সময়টাকে বিশেষজ্ঞরা পাটের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২- ১৯৭৩ অর্থবছরে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। এতে বোঝা যায়, পাট এক সময় বাংলার অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলো।
কিন্তু ধীরে ধীরে পাট শিল্পের জৌলুস কমতে থাকে। শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে পৃথিবী আধুনিক হতে থাকে। আসতে থাকে নানা প্রযুক্তি ও টেকসই বস্তু। কিন্তু পাট শিল্প ও এর কারিগররা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। পাট শিল্পের পতনের অন্যতম কারণ হতে পারে কৃত্রিম আঁশ এবং প্লাস্টিক- পলিথিনের অবাধ ব্যবহার। আমরা যদি আশেপাশে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো চারদিকে প্লাস্টিক-পলিথিনের ছড়াছড়ি ও পরিবেশ দূষণের অগুণিত উদাহরণ। সহজলভ্য এবং টেকসই হওয়ার দরুণ মানুষ প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকেছে আর পাটের প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছে।
প্লাস্টিক-পলিথিন সহজে মাটিতে মিশে যেতে পারেনা। প্রায় ৩০০ বছর সময়কাল অতিবাহিত হলে এসব বস্তু মাটিতে পচনযোগ্য হয়। ফলে এই প্লাস্টিক- পলিথিন দ্বারা মাটির জন্য উপকারী জীব ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মাটির উর্বরতা হ্রাস পেতে থাকে। আবার এই প্লাস্টিক-পলিথিন পুড়িয়ে ফেললে অনেক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়। যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই গ্যাস গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্যও দায়ী। তাই বর্তমানে উন্নত দেশগুলো পলিথিনের পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প কিছু ব্যবহার করার চিন্তা- ভাবনা করছে।
আর তাই সোনালি আঁশকে নিয়ে আবার আশার আলো দেখা যায়। ২০০৯ সালের পর থেকে হঠাৎ করেই পাট- শিল্পের হতাশার মাঝে কিছুটা আশার আলো উদিত হয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী প্রয়াত মোবারক হোসেন পথ দেখিয়েছেন সোনালি ব্যাগের। যে পলিথিনের কবলে পড়ে ছিটকে পড়েছিল পাট, তেমন পলিথিনই এবার পাট থেকে তৈরির পদ্ধতি উদ্ধাবন করেছিলেন এই দেশীয় বিজ্ঞানী। এই পলিথিন পচনশীল, ফলে পরিবেশ বান্ধবও বটে।
এই সোনালি ব্যাগের কাঁচামাল পাট নয়,বরং পাটজাত পণ্যের ফেলে দেওয়া এক অংশ ‘ক্যাডিস’। এতদিন যে ক্যাডিস পুড়িয়ে ফেলা হতো, আজ সেই ক্যাডিস থেকেই পাটের পলিমার বের করে পলিথিন তৈরির পদ্ধতি বের করেছিলেন বিজ্ঞানী মোবারক হোসেন।
এছাড়া গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে, আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়। যা প্রকৃতির সবুজময়তা ও সতেজতা পুনরুদ্ধারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
দেশে পাটের স্বর্ণযুগ ফেরানোর প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পাট দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাট চাষে আগ্রহী করে তুলতে সরকার বাছাইকৃত পাট চাষিদের যেমন পুরস্কৃত করছে, তেমনি পাটের দেশীয় বাজার বৃদ্ধি করতে উদ্যোক্তাদেরও পুরস্কৃত করছে। ২০২০ সালে জাতীয় পাট দিবসে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে সেরা পাট ও পাটবীজ গবেষক, পাটবীজ উৎপাদনকারী, পাট চাষি, উদ্যোক্তা, মহিলা উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের পুরস্কৃত করা হয়। যা পাট চাষ ও এর বাজার তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পাটের বাজার বৃদ্ধি করতে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যেমন: ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন- ২০১০’ আইন প্রণয়ন করা হয়। ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩’ এ অধিকতর সংশোধন করে ‘প্রোল্টি ও ফিসফিড’ সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তা বাধ্যতামুলক করে সরকার। আইন অনুযায়ী ৬টি পণ্য – ধান,গম, ভুট্টা,সার ও চিনি পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামুলক করা হয়। সরকারের এমন আইন প্রণয়ন নিশ্চিতভাবেই পাটের সোনালী সময় ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে।
সরকারের পাশাপাশি যদি জনগণও এগিয়ে না আসে, তাহলে সরকারের সব উদ্যোগ ও পাট- শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ রুপে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আমাদের পলিথিনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পাটপণ্যের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। ঘরে পাটের তৈরি একটি পণ্যও যদি আমরা ব্যবহার করি, তাহলে সেটিও পাটের সোনালী সময় ফিরিয়ে আনতে ও বাজার তৈরি করতে ভূমিকা রাখবে। দেশের বানিজ্যিক গোষ্ঠীকেও এক্ষেত্রে সদয় ভূমিকা পালন করতে হবে। পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের বিদেশি বাজারের পাশাপাশি দেশীয় বাজারের দিকটিও দেখতে হবে।
দেশে পাটপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ও বাজার বাড়াতে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিশুদেরকে পাটের সাথে পরিচয়, এর ব্যবহার ও ইতিহাস সম্পর্কে জানাতে হবে। পাট সম্পর্কিত রচনা ও নানা সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে পাটের প্রতি শিশুদের আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব। স্কুলগুলোতে শিশুদের হাতে পাটের স্কুলব্যাগ,পেনসিল বক্স তুলে দিলে তারা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাটের সাথে পরিচিত হবে। আগামী প্রজন্মের মাঝে পাট ও এর উপকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা তৈরি করতে পারলে আগামীতে দেশে পাটের বৃহৎ বাজার সৃষ্টি হবে।
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ৬ মার্চ সরকারিভাবে পালন হবে জাতীয় পাট দিবস। কিন্তু, এই দিবস পালনের মধ্যেই যদি আমরা সীমাবদ্ধ থাকি, তবে আমরা পাটের সেই সোনালী সময় ফিরিয়ে আনতে পারবোনা। দিবস পালনের পাশাপাশি পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি ও পাট চাষ আধুনিকীকরণে আমাদের কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। তাই পাট দিবসে আমরা সচেতন হই পাট ও এর ভূমিকার ব্যাপারে, ফিরিয়ে আনি পুরনো সেই ঐতিহ্য। ফলে আমাদের অর্থনীতি হবে আরো গতিশীল, আমরা হবো আরো উন্নত।