পৃথিবীর ইতিহাসে ৬টি রহস্যময় ঘটনা

কাকতালীয়! নাকি রহস্যময় ঘটনা! আপনি অবশ্যই বিভিন্ন সময়ে আপনার বন্ধুর সাথে এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ, আমাদের এই চিরচেনা পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলোর কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া, ব্যস্ত জীবনে সেগুলোর কারণ নিয়ে ভাবনার বিলাসিতাটাও আমাদের থাকে না। তাই, অনেক ঘটনাই থেকে যায় আমাদের অগোচোরে।

6 most mysterious events in the history of the world

আপনি যদি একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন যে এই বিশ্ব জগত কী বিচিত্র উপায়ে নিজের রূপ বদলাচ্ছে। অনেকেই হয়ত কিছু উত্তর সাজিয়ে অদ্ভূত কান্ডগুলোকে বিচার করার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানের উত্তরোত্তোর উন্নতির ফলে পূর্বে অমীমাংসিত অনেক রহস্যেরই ধীরে ধীরে সমাধান মিলছে। এরপরেও আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে ভেলকি দেখিয়ে অনেক ঘটনাই রহস্যময় পর্দার অন্তরালে থেকে যাচ্ছে।

এখন আমরা সেগুলোর ভেতর থেকে ৬ টি ঘটনার ব্যাপারে জানবো, যেগুলো পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলো।

১/ ৩টি জাহাজডুবির ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র মহিলা

টাইটানিক, ব্রিটানিক এবং অলিম্পিক। টাইটানিক নামটির সাথে অবশ্যই আপনি পরিচিত। এমনকি, ১৯১২ সালে ডুবে যাওয়া এই অভিশপ্ত জাহাজ নিয়ে অনেক গল্পও শুনেছেন। একই ক্যাটাগরির জাহাজ ব্রিটানিক একই দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলো ১৯১৬ সালে। আরএমএস অলিম্পিক জাহাজটির একটি বৃটিশ যুদ্ধ জাহাজের সাথে সংঘর্ষ হয় ১৯১১ সালে। অবশ্য সেটি সামান্য ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে অলিম্পিক শেষমেষ বন্দরে ফিরতে পেরেছিলো।

এই তিনটি জাহাজেই যাত্রী সেবিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন ভায়োলেট জেসুপ। কাকতালীয় বলুন বা সৌভাগ্য বলুন; ভায়োলেট শেষমেষ বেঁচে গিয়েছিলেন এই ভয়াবহ তিনটি দুর্ঘটনা থেকে।

১৯৭১ সালে ৮৩ বছর বয়সে “মিস আনসিঙ্কেবল” নামে পরিচিত ভায়োলেট জেসুপ মারা যান হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।

 

২/ বিধ্বস্ত হওয়া দুটি বিমানের যাত্রী তালিকায় অনুপস্থিত একমাত্র যাত্রী

ঘটনা দুটি ২০১৪ সালের; মালয়শিয়ার দুটি বিমানকে ঘিরে। একটি গুলিবিদ্ধ হয়ে ইউক্রেনে বিধ্বস্ত হয়। আরেকটি হারিয়ে যায় ভারত মহাসাগরে। দুটি ঘটনা ঘটেছিলো ভিন্ন সময়ে, কিন্তু একই আকাশপথে।

তবে সব থেকে অবাক ব্যাপার হলো, মার্টিন ডি জঙ নামে একজন ডাচ সাইক্লিস্ট দুটো বিমানেই টিকেট বুকিং দিয়েছিলেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত সস্তা দামের ফ্লাইট পেয়ে যাওয়ায় একদম শেষ মুহুর্তে টিকেট বদলে নেন।

কাকতালীয় বা রহস্যময় ঘটনা; যা-ই ভাবুন না কেন, লোকটি তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পেরেছিলো।

 

৩/ হিরোশিমা এবং নাগাসাকি বোমাবর্ষণে বেঁচে যাওয়া একমাত্র মানুষ

সুটোমো ইয়ামাগুচিকে আপনি ভাগ্যবান বা দুর্ভাগা; দুটোই ভাবতে পারেন। ভাগ্যবান কারণ তিনি দুটো দুর্ঘটনাতেই বেঁচে গিয়েছিলেন। আর, দুর্ভাগা কারণ তিনি দুটো ভয়াবহ সময়ে উপস্থিত ছিলেন।

ইয়ামাগুচি হিরোশিমার বিস্ফোরণের কেন্দ্র থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে ছিলেন। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যান। তার বাম কানের পর্দা ফেটে যায় আর শরীরের উপরের অর্ধেক অংশ পুড়ে যায়।

বাঁচার জন্য হিরোশিমা থেকে পালিয়ে নাগাসাকিতে যেতেই ২য় সাদা আলোর ঝলকানি দেখতে পান। এখানেও তিনি কেন্দ্রবিন্দু থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে ছিলেন। এরপরেও তিনি বেঁচে যান।

অবশেষে ২০১০ সালে ৯৩ বছর বয়সে দুরারোগ্য ক্যান্সারে মারা যান সুটোমো ইয়ামাগুচি।

 

৪/ অ্যাডগার অ্যালেন পো’র ভবিষ্যদ্বাণী

দ্যা ন্যারেটিভ অফ আর্থার গর্ডন পিম অফ নান্টাকেট- ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে রচিত বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক অ্যাডগার অ্যালেন পো এর জনপ্রিয় উপন্যাস।

জাহাজডুবিতে মাঝ সাগরে হারিয়ে যাওয়া চারজনের একটি নাবিকদল সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের টিকে থাকার জন্য যেকোনো একজনকে মরতে হবে। অতঃপর মারা যাওয়া নাবিকের মাংস খেয়ে বাকিরা বেঁচে থাকবে। তারা এলোমেলো ভাবে বিভিন্ন আকারের খড়কুটো মুঠোবন্দি করে। অতঃপর যার মুঠোতে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট খড় পড়বে সেই একজনকে বলি হতে হবে। উপন্যাস অনুসারে যে চরিত্রটি নির্বাচিত হয়েছিলো তার নাম রিচার্ড পার্কার।

১৮৮৪ সালের ৫ই জুলাইয়ের ঘটনা। একটি প্রমোদতরী সাউদাম্পটন থেকে সিডনী যাচ্ছিলো। কেপ অফ গুড হোপ নামক দ্বীপ থেকে প্রায় ১৬০০ দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট খাট জাহাজটি প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পরে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। দ্বীপটি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ পেনিনসুলার আটলান্টিক উপকূলে অবস্থিত।

নিরুদ্দেশ অবস্থায় মাঝ সাগরে ভাসতে ভাসতে ক্ষুদ-পিপাসায় ১৮-১৯ দিন কেটে যায়। অবশেষে বেপোরোয়া নাবিকদল খড়কুটোর মাধ্যমে একজনকে বাছাই করে বলি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- এখানে নির্বাচিত ব্যক্তিটির নাম ছিলো রিচার্ড পার্কার!

রহস্যময় ঘটনা যতভাবে আপনার সামনে হাজির হতে পারে, এটা হয়ত তার মধ্যে সব থেকে অদ্ভূতুড়ে। অন্যথায়, সহজ বিচারে অকপটে অ্যাডগার অ্যালেন পোকে ভবিষ্যত বক্তা মেনে নেয়া যায়।

 

৫/ হুভার ড্যামের রহস্যময় ঘটনা

আমেরকিার নেভাডা এবং আরিজোনা রাজ্যের সীমান্তে প্রবাহিত কলোরাডো নদী। আর এ নদীটিতেই বাঁধ দিতে ১৯৩১ থেকে শুরু করে হুভার ড্যাম নির্মাণের কাজ শেষ হয় ১৯৩৬ সালে। ড্যামটি ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাংশ এবং আরিজোনাকে রক্ষা করে বিপজ্জনক বন্যা থেকে।

ড্যামটির অবস্থানের ভৌগলিক সার্ভে শুরু হয়েছিলো ১৯২২ সালে। সেই সময় থেকে শুরু করে ড্যাম নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মোট ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে প্রথম জন ছিলেন জর্জ টায়ার্নি। তিনি সার্ভে করতে এসে কলোরাডো নদীতে ডুবে মারা যান। সময়টা ছিলো ১৯২২ সালের ২০ ডিসেম্বর।

আর শেষ জন ছিলেন প্যাট্রিক টিয়ার্নি; জর্জ টিয়ার্নির ছেলে। তিনি মারা যান যখন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। মৃত্যুর তারিখ ১৯৩৫ সালের ২০ ডিসেম্বর।

সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপারটি উপেক্ষা করে পিতা পুত্রের মৃত্যুটা শুধুই হতে পারে কাকতালীয়। আর বিজ্ঞান ভিত্তিক কারণ খুঁজে ক্লান্ত হয়ে গেলে রহস্যময় ঘটনা ভেবে ভুল করবেন না যেন।

 

৬/ ট্যামার্লেন সমাধিতে খোদাই করা সাবধানবাণী

১৯৪১ সালের ২০ জুন, সোভিয়েত প্রত্নতত্ত্ববিদরা উজবেকিস্তানে খুঁজে বের করেন ট্যামার্লেনের সমাধি। ট্যামার্লেন নিজেকে দেখতেন চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকার হিসেবে। মধ্য এশীয়া এবং পারস্যের তিমুরিদ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এই তুর্কী-মঙ্গল বিজেতা।

ট্যামার্লেন সমাধিতে একটি সাবধানবাণী খোদাই করা ছিলো। তাতে লেখা ছিলোঃ

“যে আমার সমাধি উন্মোচন করবে, সে আমার থেকে আরো ভয়ানক এক আক্রমণকারীকে মুক্ত করে দিবে।”

নিশ্চিতভাবেই প্রত্নতত্ত্ববিদরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন না। স্বভাবতই তারা সাবধানবাণী উপেক্ষা করে সমাধি উন্মুক্ত করেন। তার ২ দিন পর সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর অপারেশন বারবারোসা পরিচালনা করেন অ্যাডল্ফ হিটলার। অপারেশন বারবারোসাকে সর্ব সময়ের বৃহৎ সামরিক আক্রমণ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এর কারণে ২৬০ লক্ষ সোভিয়েত লোক মারা যায় যার ৮৬ লক্ষই ছিলো সোভিয়েত সেনা। প্রায় ১৭১০ টি সোভিয়েত শহর এবং ৭০ হাজার গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়।

বিঃশ্বাস অবিঃশ্বাসের বিতর্ককে ছাপিয়ে এটি হয়ত ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, যা কিংবদন্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার কঠিন শিক্ষা দিয়ে গেছে।

সব কিছুর পরে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দিয়ে যতই পৃথিবীটাকে বেধে ফেলি না কেন, মহাকাল সকল বাধা ডিঙিয়ে রহস্যময় ঘটনা ঘটিয়ে বারবার আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমরা হয়ত আমাদের সিদ্ধান্তগুলোকে অনেক ভেবে ভেবে সাজাচ্ছি। তারপর কাজগুলোকে অনেক সতর্কতার সাথে সম্পন্ন করছি। এরপরেও ফলাফলগুলো কাঙ্ক্ষিতভাবে নাও হতে পারে। যার একটা বড় অংশ আবর্তিত হয় ভাগ্যকে কেন্দ্র করে। হয়ত বা পুরোটাই! প্রিয় পাঠক, আপনার কি মনে হয়? এ ব্যাপারে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত আমাদের জানাতে পারেন। আর লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদের অবস্থানটা জানতে পারেন।

 

তথ্যসূত্রঃ

১. Mysteries Unsolved

২. ABC News

৩. Independent

৪. Wikipedia

৫. US Bureau of Reclamation

৬. Arara Central Asia

Similar Posts