দুশ্চিন্তা দূর করার উপায়
আচ্ছা বলুন তো, এমন কোন নেশা আছে যেটাতে পৃথিবীর প্রায় ৯৯.৯% মানুষই আসক্ত? পারলেন না তো? আমি বলি, সেটা হলো এডিকশন টু থিংকিং অর্থাৎ চিন্তা করার প্রতি আসক্তি।
একজন চেইন-স্মোকার যেমন অকারণে একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে চলে, ঠিক তেমনই একজন এডিক্টিক থিংকার অকারণে একের পর এক চিন্তা করে চলে। আর সব থেকে বড় কথা সে চাইলেও সেটা থামাতে পারে না। বিশ্বাস না হলে এখনই একবার ট্রাই করে দেখুন না। পরবর্তী মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য রকম চিন্তা না করে, মনের ভেতর কোনো রকম একটাও কথা না বলে থাকার চেষ্টা করুন। কি হলো পারলেন না তো?
দূঃখের কিছু নেই আমাদের মধ্যে ৯৯.৯% লোকই আপনার দলে। যারা নিজেরা নিজেদের মাইন্ডকে কন্ট্রোল করে না বরং তাদের মাইন্ড তাদেরকে কন্ট্রোল করে। আর মাইন্ডের ফেবারিট ফুড হচ্ছে ফিলিংস। তাই মাইন্ড আমাদেরকে ইউস করে সারাক্ষণ খাবারের যোগান বানিয়ে চলে। এক কথায় বললে, আমরা আমাদের মাইন্ডের দাসে পরিণত হয়েছি।
ঠিক এরকমই অবস্থা ছিল The Power of NOW এর বইয়ের লেখক Eckhart Tolle‘র। যেটা ঊনত্রিশ বছর বয়সে তার জীবনের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। মাসের পর মাস দুশ্চিন্তা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিতে শুরু করে এবং এক সময় জীবনের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা থেকে এমনকি ওনি সুইসাইড করারও সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় একদিন রাতে ওনি এমন কিছু ডিসকাভার করেন, যা তার জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই বদলে দেয়। তিনি এক শান্তিতে পরিপূর্ণ নতুন জীবন খুঁজে পান। তার এই হঠাৎ পরিবর্তন দেখে লোকজন যখন তাকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, যে এটা কিভাবে সম্ভব হলো?
ওনি তাদের সাথে সেই পদ্ধতিটা শেয়ার করতে শুরু করতে শুরু করেন এবং ১৯৯৭ সালে The Power Of NOW বইটি প্রকাশ করেন।
এরপর বইটি শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকাতেই তেত্রিশটি ভাষায় অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হয়। এবং প্রায় ত্রিশ লক্ষ কপিস বিক্রি হয়। বইটি সেই সমস্ত মানুষদের জন্য অত্যন্ত উপকারী, যারা নিজেদের অতীতে আটকে রয়েছে। যারা নিজের অজান্তেই নিজের মাথার মধ্যে নিজেকে সারাক্ষণ বন্দি করে রেখেছে এবং যারা এই অপেক্ষায় রয়েছে, যে কোনদিন হয়তো বাইরে থেকে কোন কিছু এসে তাকে খুশি করে দেবে।
এ বইটি তাদের জন্যও অত্যন্ত কাজের, যারা বেশিরভাগ সময়ই সবকিছুতে অভিযোগ করতে থাকে এবং যাদের প্রতিটা দিন দুশ্চিন্তার উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে কেটে চলেছে। যদি আপনার ক্ষেত্রেও এগুলো প্রযোজ্য হয়, তাহলে আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়তে থাকুন। তো চলুন শুরু করা যাক।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়
Eckhart Tolle মনে করেন, আমরা সেই প্রতিটা মুহূর্ত নষ্ট করি যে মুহূর্তগুলোতে আমরা অতীতের ব্যাপারে আফসোস করে কাটাই অথবা ভবিষ্যতের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করে কাটাই। কারণ আমরা সব সময় বর্তমানেই বাঁচি। যা কিছু ঘটে যা কিছু আমরা অনুভব করি, সে সমস্ত কিছু ঘটে শুধু এবং শুধুমাত্র বর্তমানে। যদি আপনি একটু ভেবে দেখেন, অতীত আর কিছুই নয় শুধুমাত্র বর্তমান মুহূর্তের সমষ্টি যেগুলো অলরেডি পেরিয়ে গেছে এবং ভবিষ্যৎও হলো কতগুলো বর্তমান মুহূর্তেরই সমষ্টি যেগুলো আসতে চলেছে।
তাই বর্তমান ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় বাঁচার চেষ্টা করাটা পুরোটাই অর্থহীন প্রচেষ্টা। যদি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আপনাকে একটা প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে হয়, তাহলে অতীতের সেই সময়টুকু আপনি আজ নয় কাল করে নষ্ট করে ফেলেছেন, সেটা নিয়ে আফসোস করা বা ভবিষ্যতে যে আপনি একটা ভীষণ চাপের সম্মুখীন হতে চলেছেন, সেটার ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করা, এদের মধ্যে কোনটাই কোন কাজের না। শুধুমাত্র সেটাই কাজের হবে যদি আপনি বর্তমানে সময়টাতে কাজটা করতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে কাজটা শেষ করার দিকে এগুতে থাকেন।
আপনি আপনার মাইন্ড নন
আমাদের মাইন্ড অত্যন্ত পাওয়ারফুল একটা টুল, যদি সেটাকে আমরা সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করি। কিন্তু সমস্যাটা হলো, আমরা বেশিরভাগই সচেতনভাবে আমাদের নিজেদের মস্তিস্ককে ব্যবহার করি না। বরং আমাদের মস্তিষ্কের দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
একবার নিজেকে নিজে এই প্রশ্নটা করে দেখুন, আমি কে এবং আমার পরিচয়টা ঠিক কি? যদি আপনার উত্তর এইগুলো নিয়ে তৈরি হয়, যে আপনি একজন ছাত্র বা আপনি একজন সরকারি কর্মচারী বা যদি আপনার উত্তর আপনার সামাজিক পরিচয়, শিক্ষা, দক্ষতা, সম্পর্ক, বিশ্বাস, ধর্ম এমনকি কোন পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে তৈরি হয়, তাহলে আপনি একবার ভেবে দেখুন, সত্যি বলতে কি এগুলোর কোনটাই কি আপনি? নাকি এগুলো আপনার মস্তিষ্কের দ্বারা বাইরে থেকে সংগ্রহ করা শুধুমাত্র কিছু তথ্য। মৃত্যুর পরের কথা না হয় বাদই দিলাম, এগুলোর কোনটাই কি ঘুমের সময়ও আপনার সঙ্গে থাকে? থাকে না।
কিন্তু আপনি তো ঘুমের সময়ও প্রেজেন্ট থাকেন। যদি তা না থাকতেন, তাহলে কিভাবে জানতেন যে আপনি সেই সময় ঘুমিয়েছিলেন বা আপনি কোনো স্বপ্ন দেখেছিলেন? Eckhart Tolle এই জিনিসগুলোকেই বলেছিলেন Ego। যেগুলো আমরা নই, কিন্তু আমরা সেগুলো নিজেদের অংশ বলে মেনে নিয়েছি। যেগুলো শুধুমাত্র আমাদের সংগ্রহ করা কিছু তথ্য। তাহলে আপনি আসলে কে? কি আপনার পরিচয়? সেটা জানার মানেই হলো এনলাইটেনমেন্ট।
এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকিত উপায় আসবে
যেকোনো রকম মানসিক দুঃখ বা কষ্টের প্রধান উৎস হলো আমাদের মিথ্যা Ego-স্বয়ং কেন্দ্রিক চিন্তা। সে সমস্ত জিনিস যেগুলো আমরা নিজেদের অংশ বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু আসলে যেগুলো আমরা না। যদি আপনি শুধুমাত্র এই মুহূর্তটাতেই বেঁচে থাকেন, তাহলে কি আপনার জীবনে কোনরকম কোন কষ্ট সমস্যার অস্তিত্ব আছে?
কষ্ট তখনই তৈরি হয় যখন অতীত বা ভবিষ্যতের নিজেদের ফলস আইডেন্টিফিকেশন বেজ করে কিছু চিন্তা করি এবং প্রেজেন্ট মোমেন্ট থেকে সরে গিয়ে অতীত বা ভবিষ্যতে বাঁচার চেষ্টা করি।
ভাবুন, কোন একটা যন্ত্রের সাহায্যে আপনার সমস্ত স্মৃতিগুলোকে এক মিনিটের জন্য আপনার ব্রেন থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো এবং ওই এক মিনিট আপনি শুধু এবং শুধুমাত্র বর্তমানটাকে অনুভব করলেন, চারিদিকে কি কি রয়েছে, কিসের কিসের আওয়াজ শুনতে পারছেন, কিসের কিসের গন্ধ আপনার নাকে আসছে, কি কি স্পর্শ অনুভূতি আপনি অনুভব করছেন, অর্থাৎ কোনো রকম কোনো জাজমেন্ট ছাড়া আপনি শুধু এবং শুধুমাত্র যা ঘটছে, সে গুলোকে অনুভব করছেন। তাহলে কি এই মুহূর্তে, আপনার জীবনে কোনো কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা, সমস্যা কিচ্ছু আছে?
এবার ভাবুন, কোন যন্ত্র ছাড়াই যদি আপনি নিজেই এটা করতে পারতেন এবং এক মিনিটের জন্য নয় যতক্ষণের জন্য ইচ্ছা ততক্ষণ করতে পারতেন? তাহলে জীবন কেমন হতো? কষ্টের শেষ অর্থাৎ এনলাইটেনমেন্ট।
এক্ষেত্রে অনেকেরই একটা ভুল ধারণা জন্ম নেয়। তাহলে আমরা কি আমাদের মেমোরিকে ব্যবহারই করব না? না, সেটা নয়। এক্ষেত্রে কন্ট্রোলটা পুরোপুরি আপনার হাতেই থাকবে ঠিক ওই যন্ত্রের মত। অর্থাৎ আপনি যখন চাইবেন আপনার মাইন্ডকে চুপ করিয়ে সরিয়ে রাখবেন, আবার ঠিক যখনি দরকার পড়বে, সেটাকে ব্যবহার করে অতীত থেকে শিখবেন এবং ভবিষ্যতের জন্য লক্ষ্য তৈরি করবেন।
কিন্তু ঠিক যতটা দরকার অর্থাৎ তখন আপনি আপনার মস্তিষ্কের দাস নয় বরং আপনার মস্তিষ্ক আপনার দাসত্ব পালন করবে। এই সমস্ত কিছু শুনে আমাদের মাথায় একটাই প্রশ্ন আসে, সবই ঠিক আছে কিন্তু এগুলো কি আদৌ সম্ভব?
সম্ভব কি সম্ভব না তা অলরেডি অজস্র মানুষ এই অবস্থানে পৌঁছে প্রমাণ করে দিয়েছেন। Eckhart Tolle তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। যেকোনো স্কিল অর্জন করার জন্য দরকার প্র্যাকটিস। এক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম নেই।
Eckhart Tolle এরকমই কিছু প্র্যাকটিসের কথা তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
প্রথম প্র্যাকটিস হল, চিন্তা ভাবনা গুলোকে দেখা
এখনই একবার চেষ্টা করুন, আপনি নিজে নিজের মাথার মধ্যে ঠিক কি বলছেন, এখন মাথার ঠিক কোন জায়গা দিয়ে বলছেন, সেটা মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। দেখলেন ম্যাজিক! যে মুহূর্তে আপনি সচেতন হয়ে আপনার মস্তিষ্কের চিন্তা গুলোকে দেখতে গেলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই আপনার মাথার মধ্যে সমস্ত কথোপকথন বন্ধ।
দ্বিতীয় প্র্যাকটিস হল, আমার পরবর্তী চিন্তা বা ভাবনা কি?
বারবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, যে এরপর আমি কি ভাববো? ঠিক এরপরের চিন্তাটা আমার কি হওয়া উচিত? এই প্র্যাকটিসটা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের একটা ইফেক্টের ওপর বেজ করে তৈরি। যেটার নাম QUANTAM ZENO EFFECT যেখানে বলা হয়েছে, বারবার এই প্রশ্নটা করাতে, আসলে আপনি নিজেই নিজের থট প্রসেসটাকে স্লো করে দিতে থাকেন। যার ফলে, আপনার কাছে একটা সুযোগ চলে আসে, নিজের অটোপাইলট মুডে চলাটাকে ধরতে পারার।
তৃতীয় প্র্যাকটিস হল, সারেন্ডার
যদি বর্তমান পরিস্থিতিকে বদলানোর সত্যিই আপনার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না হয়, এমনকি আপনি চাইলেও নিজেকে সেই পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে সেক্ষেত্রে উপায় সারেন্ডার করা। সারেন্ডার করার অর্থ এই নয়, যে দুর্বল হয়ে যাওয়া বা ভেঙ্গে পড়া। সারেন্ডার করার অর্থ হলো যেটা ঘটছে, যেটা বদলানো সম্ভব নয়, সেটাকে মেনে নেওয়া এবং ভেতর থেকে সেটাকে বাধা দেওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছিল, সেটা বন্ধ করে দেওয়া।
সম্পূর্ণভাবে বর্তমানে উপস্থিত থাকার অনুভূতিটা এরকমই, যেটা কথায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ঠিক অনেকটা যেমন মাছকে পানির অস্তিত্ব বলে বোঝানোর সম্ভব না। যেটা শুধুমাত্র অনুভূতির দ্বারাই অনুভব করা সম্ভব।
স্পেস এবং সাইলেন্সও অনেকটা এরকমই। তাদের আসলে কোন ফিজিক্যাল এগজিস্টেন্স নেই। কিন্তু তবুও সাইলেন্স ছাড়া সাউন্ডের কোন অস্তিত্ব নেই।
যেমন এই বইয়ের লেখক Eckhart Tolle বলেছেন,
“Realize deeply the present moment is all you have. Make the NOW the primary focus of your life.”